|

কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি (CBT) লেখা সহ প্রতীকী চিত্র, যেখানে একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা (জটিল জট পাকানো মস্তিষ্ক) এবং সমাধানের পথ নির্দেশ করা হচ্ছে। এটি হতাশা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপ মোকাবেলায় ব্যবহৃত হয়।

কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি কী? জেনে নিন এর উপকারিতা ও কার্যপদ্ধতি

আজকের দ্রুতগতির জীবনে মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা আর বিষণ্নতা যেন আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না কীভাবে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করবো। এমন পরিস্থিতিতে Cognitive Behavioral Therapy (CBT) হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান।

এই থেরাপি পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষকে মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেছে। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি আসলে কী, কীভাবে এটি কাজ করে এবং কেন এই পদ্ধতি আপনার জন্য উপকারী হতে পারে।

কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি (CBT) মূলত কী?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি হলো একটি বৈজ্ঞানিক মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা আমাদের চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং আচরণের মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করে।

কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি (সিবিটি) চক্র: যেখানে চিন্তাভাবনা (চিন্তা), অনুভূতি (অনুভূতি) এবং আচরণ (আচরণ) একে অপরের সাথে সংযুক্ত। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি কার্যকর মনোচিকিৎসা পদ্ধতি।

এই থেরাপির মূল কনসেপ্ট হলো- আমাদের চিন্তাভাবনা আমাদের অনুভূতি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। যখন আমরা নেতিবাচক বা বিকৃত চিন্তা করি, তখন সেটা আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

যেমন ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন এবং আপনার পরিচিত একজন পাশ দিয়ে চলে গেলেন কিন্তু আপনার দিকে তাকালেন না।

  • নেতিবাচক চিন্তাঃ তিনি আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন, নিশ্চয়ই তিনি আমাকে অপছন্দ করেন। এর ফলে আপনার মন খারাপ হতে পারে।
  • ইতিবাচক চিন্তাঃ হয়তো তিনি কোনো গভীর চিন্তায় ছিলেন বা আমাকে খেয়াল করেননি। এই চিন্তার ফলে আপনি স্বাভাবিক থাকবেন।

এই থেরাপি আপনাকে শেখাবে কীভাবে ঘটনার নেতিবাচক ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে বাস্তবসম্মত চিন্তা করতে হয়। অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে মূলত বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানের ওপর জোর দেয়।

সিবিটি (CBT) কীভাবে কাজ করে?

অনেকেই মনে করেন, শুধু কথা বলে কীভাবে মানসিক রোগ সারে? আসলে সিবিটি শুধু কথা বলা নয়, এটি মস্তিষ্কের চিন্তার ধরণ বা প্যাটার্নকে রি-প্রোগ্রাম করার মতো কাজ করে। এটি মূলত চারটি প্রধান উপায়ে কাজ করে।

১. নেতিবাচক চিন্তা বা কগনিটিভ ডিস্টরশন (Cognitive Distortions) চিহ্নিত করা

প্রথম ধাপে থেরাপিস্ট রোগীকে সাহায্য করেন তার নেতিবাচক এবং অযৌক্তিক চিন্তাগুলো খুঁজে বের করতে। এই ধরনের চিন্তাকে বলা হয় Cognitive Distortion। উদাহরণস্বরূপ, “সবকিছুই আমার দোষ” বা “আমি কখনোই সফল হতে পারব না” এই ধরনের চিন্তা মানসিক সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। থেরাপিস্ট রোগীকে এই চিন্তাগুলোর প্রতি সচেতন হতে শেখান।

২. চিন্তার প্যাটার্ন পরিবর্তন করা (Cognitive Restructuring)

নেতিবাচক চিন্তা চিহ্নিত করার পর পরবর্তী ধাপ হলো সেগুলো পরিবর্তন করা। Cognitive Restructuring পদ্ধতিতে রোগীকে শেখানো হয় কীভাবে তার অযৌক্তিক চিন্তাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে হয় এবং সেগুলোকে আরও বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। এই প্রক্রিয়া রোগীর মানসিক অবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।

৩. আচরণের পরিবর্তন বা বিহেভিয়ারাল অ্যাক্টিভেশন (Behavioral Activation)

শুধু চিন্তা পরিবর্তন করলেই হবে না, আচরণেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিহেভিয়ারাল অ্যাক্টিভেশনে রোগীকে এমন কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয় যা তার মুড ভালো করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিষণ্নতায় ভোগা একজন ব্যক্তিকে হয়তো সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে বলা হয়, যদিও প্রথমে তার ইচ্ছা নাও থাকতে পারে।

৪. সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি (Problem-Solving Skills)

CBT-তে রোগীকে কার্যকর সমস্যা সমাধানের কৌশল শেখানো হয়। এর মাধ্যমে তারা জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে। থেরাপিস্ট রোগীকে সমস্যাগুলো ভাগ করে ছোট ছোট অংশে নিয়ে আসতে এবং প্রতিটি অংশের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন।

কোন কোন সমস্যার জন্য সিবিটি কার্যকর?

কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি মানসিক স্বাস্থ্যের বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, নিচের সমস্যাগুলোতে সিবিটি অত্যন্ত কার্যকর।

  • বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনঃ বিষণ্নতার চিকিৎসায় সিবিটি একটি চমৎকার থেরাপি হিসেবে বিবেচিত। হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বিষণ্নতায় CBT ওষুধের মতো কিংবা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি কার্যকর। এটি রোগীকে নেতিবাচক চিন্তার চক্র ভেঙে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।
  • প্যানিক অ্যাটাকঃ যারা জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (GAD) বা প্যানিক অ্যাটাকে ভোগেন, তাদের জন্য সিবিটি বিশেষভাবে উপকারী। এই থেরাপি রোগীকে শেখায় কীভাবে অযৌক্তিক ভয়কে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হয় এবং প্যানিক অ্যাটাকের সময় নিজেকে শান্ত রাখতে হয়।
  • অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD): ওসিডি বা শুচিবাই রোগীদের ক্ষেত্রে সিবিটি বিশেষত Exposure and Response Prevention (ERP) কৌশলের মাধ্যমে কাজ করে। এটি বিশ্বব্যাপী গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা হিসেবে স্বীকৃত।
  • পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারঃ যারা কোনো ট্রমাটিক ঘটনার পর মানসিক সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্যও সিবিটি বেশ কার্যকর। এটি তাদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রসেস করতে এবং এর প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
  • ইনসোমনিয়া (Insomnia): ইনসোমনিয়ার চিকিৎসায় CBT অত্যন্ত কার্যকর। এটি ঘুমের সাথে সম্পর্কিত রোগীর নেতিবাচক চিন্তা এবং অভ্যাস পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।
  • সম্পর্কের জটিলতা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণঃ পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণেও সিবিটি ব্যবহার করা হয়। এটি কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ায় এবং সুস্থ সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। এমনকি রাগ ও ইমোশন নিয়ন্ত্রণেও এই থেরাপি কার্যকর।

কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপির ধাপসমূহ

একজন প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট বা সাইকোথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে সিবিটি এর সেশনগুলো পরিচালিত হয়। কয়েকটি ধাপে এই থেরাপিটি সম্পন্ন হয়। যেমনঃ

  • অ্যাসেসমেন্ট (Assessment): প্রথম ধাপে থেরাপিস্ট রোগীর সমস্যা বিস্তারিতভাবে মূল্যায়ন করেন। এতে রোগীর লক্ষণ, চিন্তার প্যাটার্ন, আচরণ এবং জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়।
  • সাইকো-এডুকেশন (Psycho-education): এই পর্যায়ে রোগীকে তার সমস্যা এবং সিবিটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা হয়। নিজের সমস্যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা সুস্থতার প্রথম ধাপ। রোগী যখন বুঝতে পারে কীভাবে চিন্তা, আবেগ এবং আচরণ পরস্পর সম্পর্কিত, তখন থেরাপি আরও কার্যকর হয়।
  • কৌশল প্রয়োগ (Applying Techniques): এই ধাপে থেরাপিস্ট বিভিন্ন কগনিটিভ এবং বিহেভিয়ারাল কৌশল প্রয়োগ করেন। এর মধ্যে থাকতে পারে চিন্তার রেকর্ড রাখা (Journaling), রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ, এক্সপোজার থেরাপি ইত্যাদি।
  • হোমওয়ার্ক (Homework): CBT-এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো হোমওয়ার্ক। থেরাপিস্ট আপনাকে সেশনের বাইরে বাস্তব জীবনে কিছু কাজ করতে দেবেন। যেমনঃ ডায়েরি লেখা (Mood Diary) বা কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ভয়ের মুখোমুখি হওয়া। এই প্র্যাক্টিসটাই আসল পরিবর্তন নিয়ে আসে।
  • ফলো-আপ (Follow-up):  নিয়মিত ফলো-আপ সেশন গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সেশনগুলোতে আগের হোমওয়ার্ক এবং অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়।

সিবিটি (CBT) এর উপকারিতা

সিবিটি কেন এত জনপ্রিয়? কারণ কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির অনেকগুলো বিশেষ উপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ

  • সিবিটি বেশ সল্পমেয়াদী। বছরের পর বছর থেরাপি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত ১২ থেকে ২০টি সেশনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়।
  • অসংখ্য গবেষণা প্রমাণ করেছে যে সিবিটি বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় কার্যকর।
  • এর দির্ঘমেয়াদী প্রভাবও রয়েছে। এই থেরাপি আপনাকে নিজের থেরাপিস্ট হতে শেখাবে। থেরাপি শেষ হয়ে গেলেও আপনি শেখা কৌশলগুলো সারা জীবন ব্যবহার করতে পারেন।
  • যেহেতু এটি কোনো ওষুধ নয়, তাই এর কোনো শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

সিবিটি কি ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর?

এটি খুবই কমন প্রশ্ন। আসলে উত্তরটি নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে যে মাঝারি থেকে গুরুতর বিষণ্নতার ক্ষেত্রে সিবিটি এবং অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রায় সমান কার্যকর। সিবিটি এর কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি।

তীব্র মানসিক সমস্যা বা বায়োলজিক্যাল কারণে সৃষ্ট রোগের ক্ষেত্রে (যেমন সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার) ওষুধের পাশাপাশি সিবিটি “অ্যাড-অন চিকিৎসা” হিসেবে চমৎকার কাজ করে।

ওষুধ যেখানে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য ঠিক করে, কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি সেখানে আপনাকে সমস্যা মোকাবেলা করার দক্ষতা শেখাবে। আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে উপযুক্ত, সেটা একজন অভিজ্ঞ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই নির্ধারণ করতে পারবেন।

বাংলাদেশে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি সেবা

বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্র দ্রুত উন্নতি করছে এবং কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপির প্রয়োগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন প্রশিক্ষিত CBT Therapist পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নিরাময় হাসপাতাল একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে মানসিক রোগ এবং মাদকাসক্তির চিকিৎসায় সেবা প্রদান করে আসছি। এখানে শান্ত ও মনোরম পরিবেশে সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদা ট্রিটমেন্ট ও কেয়ার দেওয়া হয়। এছাড়া আমাদের এখানে রয়েছে অত্যাধুনিক রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসন ব্যবস্থা।

আপনার মনের যত্ন নিতে দেরি করবেন না। সঠিক গাইডেন্স এবং থেরাপি আপনার জীবনকে আবার সুন্দর ও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যোগাযোগ করুন 01758-338888 নম্বরে।

উপসংহার

Cognitive Behavioral Therapy মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি। এটি প্রমাণ করেছে যে, আমরা আমাদের চিন্তাভাবনা এবং আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, OCD, PTSD থেকে শুরু করে ঘুমের সমস্যা পর্যন্ত বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় সিবিটি অত্যন্ত কার্যকর ফলাফল দিয়েছে।

এই থেরাপির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি রোগীকে স্ব-নির্ভর করে তোলে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রদান করে। সিবিটি শুধু লক্ষণ কমায় না, বরং রোগীকে এমন দক্ষতা শেখায় যা সারাজীবন তার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক হবে।

BOOK APPOINMENT