|

বাইপোলার ডিসঅর্ডার

বাইপোলার ডিসঅর্ডারঃ লক্ষণ এবং সমস্যার কারণসমূহ

মুড সুইং (Mood Swing) যেকোনো মানুষেরই হতে পারে। তবে সেটি যদি ঘনঘন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ হয় তাহলে সেটি অস্বাভাবিক পর্যায়ের মধ্যে পড়ে। আর এই অস্বাভাবিক পর্যায়টিই বাইপোল ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder) হিসেবে পরিচিত।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার সম্পর্কে আপনি কি বিস্তারিত জানতে চান? আজকের আর্টিকেলে বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি এবং এর লক্ষ্মণ ও প্রতিকারসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি?

বাইপোলার ডিসঅর্ডার এমন একধরনের মানসিক ব্যধি, যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে। খুব তুচ্ছ কারণেও ব্যক্তি অতিরিক্ত উত্তেজনায় বা বিষন্নতায় ভোগে।

বাইপোলার শব্দের অর্থ “দুই প্রান্ত”। বাইপোলার নাম শুনলেই বোঝা যায় এ রোগের প্রধান দুই ধরনের লক্ষণ রয়েছে, যা সম্পূর্ণ একে অন্যের থেকে বিপরীত। যাকে আমরা তুলনা করতে পারি- উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর সাথে।

বাইপোল ডিসঅর্ডার দুই ধরনের। একটি হচ্ছে ম্যানিয়া বা ম্যানিক এপিসোড এবং অন্যটি হচ্ছে ডিপ্রেশন বা ডিপ্রেসিভ এপিসোড

ম্যানিক এপিসোডে রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রায় উত্তেজনা কাজ করে এবং আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে।অকারণেই অনেক হাসিখুশি বোধ করে।

অন্যদিকে, ডিপ্রেসিভ এপিসোডে রোগী খুবই বিষন্নতায় ভোগে। নিজেকে নিজেই হেয় প্রতিপন্ন করে। আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ‘এপিসোড‘ কথাটি বলার কারণ হচ্ছে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের দুই প্রকারের যেকোনো একটি নির্দিষ্ট পিরিয়ড পর্যন্ত চলতে পারে।

আবার কিছুদিন পরেই বাইপোলারের অন্য ধরণটি বা আগের ধরণটিই দেখা দিতে পারে। এই নির্দিষ্ট পিরিয়ড যেমন ২-৩ মাস ধরে দেখা যায় বলে এটাকে এপিসোড হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার কেন হয়?

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ সম্পর্কে আজও জানা যায়নি। এ বিষয়ে গবেষকরা গবেষণা করছে।

তবে এখন পর্যন্ত যে যে বিষয়গুলোকে গবেষকরা এ রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সেগুলো হলো-

  •  মানসিক গঠনগত সমস্যার কারণ।
  • জিনগত কারণ। সহজভাবে বললে, পূর্ব প্রজন্মের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যাওয়া বোঝায়।
  • শরীরে প্রয়োজনীয় হরমোনের অভাব ঘটা।
  • একাকিত্ব ভর করা।
  • পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে অবহেলা পাওয়া।
  • বড়-সড় মানসিক চাপ।
  • অনেক বছর আগের মানসিক ধাক্কার ঘটনা মনে মনে পুষে রাখা।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?

এ রোগে কেউ ভুগলে নিচের এই লক্ষ্মণ রোগীর মধ্যে দেখা যায়। যেগুলোর মাধ্যমে সহজেই বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। যেমন-

ম্যানিক এপিসোড

  • কোনো কারণ ছাড়াই রোগী হাসি-খুশি অনুভব করে। এক্ষেত্রে তাঁর আনন্দ ফূর্তির মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক পরিমাণে হয়ে থাকে।
  • নিজের মধ্যে ভিত্তিহীন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। ধরুন, কোনো রোগীর কাছে ১০০,০০০ টাকা আছে যেটা দিয়ে বিশ্বাস করে সে একটা হসপিটাল বানাতে পারবে।
  • নিজেকে খুবই বড়-সড় ব্যক্তিত্বের মানুষ মনে করে। ধরুন- তিনি নিজেকে মানুষের কাছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে দাবি করে। অথচ এই কথাগুলো রোগী কখনো প্রতারণা করে বলে না। সে নিজের মনে এগুলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
  • যুক্তিহীন বিষয়ে অনর্গল কথা বলা।
  • অপরিচিত মানুষের সাথে নিজে যেচে আলাপ করা। নিজের গোপনীয় বিষয়গুলে শেয়ার করা।
  • নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস বিলিয়ে দেওয়া।
  • অসম্ভবকে সম্ভব করবে এরকম এরকম দৃঢ় বিশ্বাস থাকা।
  • অতিরঞ্জিত সাজগোজ করা। উদাহরণস্বরুপ- বার্থডে পার্টিতে বিয়ের সাজের মতো জাঁকজমকপূর্ণ সাজে আ্যটেন্ড করা।
  • অতিরিক্ত যৌন চাহিদায় ভোগা।
  • অপ্রয়োজনীয় খরচ করা।

ডিপ্রেসিভ এপিসোড

ডিপ্রেসিভ এপিসোড ম্যানিক এপিসোডের একদমই বিপরীত। এ পর্যায়ে-

  • রোগী ভীষণ বিষন্নতার মধ্যে থাকে।
  • নিজে হীনম্মন্যতায় ভোগে। যেমন- তাঁর দ্বারা কিছু করা সম্ভব না।
  • আত্মহত্যা করার ঝোঁক থাকে।
  • ভালোমতো ঘুম হয় না।
  • খাবারের প্রতি অনীহা থাকে।
  • কারোর সাথে মিশতে না চাওয়া।
  • সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।
  • মাদকাসক্ত হওয়া।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে উপরের এই লক্ষ্মণগুলো স্পষ্ট হয়। যা রোগীর স্বাভাবিক জীবন থেকে ভিন্ন ঘটনাসমূহ।

বলা যায়, যদি কোনো রোগী স্বাভাবিক জীবনে কৃপণ হয়, তাহলে ম্যানিক এপিসোডে সে নিজের দামি দামি জিনিসগুলো মানুষকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না।

এটা সে নিজের উদার মানসিকতা থেকে করে না, বরং সাময়িক ডিপ্রেসিভ এপিসোডে বশীভূত হয়ে করে।

মুড সুইং মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, যেটি অবশ্যই প্রতিটা মানুষের সাথে হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার হতে হলে মুড সুইং এর এই ব্যাপারগুলি দীর্ঘসময় বা একটা পিরিয়ড ধরে চলবে। কমপক্ষে ১ সপ্তাহ বা ১৫ দিন। আবার নির্দিষ্ট সময় পরে আবার শুরু হবে।

যেমন বছরে ৩-৪ মাস ধরে একটি এপিসোড চলার পরে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসল। পরবর্তীতে ৬-৭ মাস পরে আবার দেখা দিল। তাই বলা যায়, সকল মুড সুইং-ই বাইপোলার ডিসঅর্ডার নয়।

বাইপোল ডিসঅর্ডার

বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির উপায় কি? 

বাইপোলার ডিসঅর্ডার এখনো পর্যন্ত সেভাবে সম্পূর্ণরুপে নিরাময় করা সম্ভব না। এবিষয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মেখলা সরকার বলেন, “এই রোগটি ডায়বেটিসের মতো, যা কখনো নির্মূল করা যায় না তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।”

এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রোগীর পরিবারের সদস্যের ভূমিকা মূখ্য। পরিবারের লোকজনদেরকে রোগীর কাজকর্মের ওপর নজর দিতে হবে। রোগী কোনো ভুল করে বসলে তাকে কঠিনভাবে কিছু বলা যাবে না৷

রোগীর কোনো ইচ্ছেতে সরাসরি না বলা উচিত হবে না, তর্ক করা যাবে না। প্রয়োজনে কৌশল অবলম্বন করে অন্যদিকে তার মন ঘুরিয়ে দিতে হবে।

রোগীকে সঙ্গ দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে বুঝাতে হবে, যদিও ম্যানিক এপিসোডে রোগী খুবই বেপরোয়া থাকে। কারোর কথাই শুনতে চাই না তেমন। তাকে নিয়মিত খাওয়ানো এবং ঘুমানোর বিষয়টাকে নিশ্চিত করতে হবে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা ও ওষুধ

বাইপোলার ডিসঅর্ডার সম্পর্কে জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউট, ঢাকা এর মনোবিজ্ঞান চিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন-

  1. বাড়িতে রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দ্রুত হাসপাতালে আনতে হবে।
  2. হাসপাতালে রোগীকে প্রাথমিক পর্যায়ে মুড স্টিবিলেইজার এবং এন্টি-সাইক্রিয়েটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনে ঘুমের ওষুধও দিয়ে থাকেন।
  3. পরবর্তীতে যখন উপসর্গগুলো কমে যায় তখন ডাক্তারেরা মুড স্টিবিলেইজার স্বাভাবিক পরিমাণ চেয়ে কম দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সকল ধরনের ওষুধ স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের পুরো এপিসোডে শুধু ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কিংবা ইন্টারনেটের তথ্য থেকে রোগীকে কোনো ওষুধ সেবন করতে দেওয়া উচিত নয়। এজন্য নিরাময় হাসপাতালের অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।

সারসংক্ষেপ

পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ মিলিয়নের বেশি মানুষ বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ১৮-২৯ বছর বয়সের মানুষ, ৪.৭%।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে ১৫%-১৭% ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে প্রবৃত্ত হয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগটি কোনো তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় নয়।

এ রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পাওয়া কিংবা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তবে এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ও সঠিক চিকিৎসা।

BOOK APPOINMENT