হ্যালুসিনেশন হলো আমাদের ইন্দ্রীয় দ্বারা এমন কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভব (দেখা, শোনা, ঘ্রাণ পাওয়া, স্পর্শ পাওয়া, স্বাদ পাওয়া) করা যা বাস্তবে নেই। হ্যালুসিনেশন কোনো মানসিক রোগ না হলেও এটি একটি মানসিক সমস্যা এবং স্নায়বিক বা মানসিক অসুস্থতার কারণে সৃষ্টি হয়। আর বিভিন্ন মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে একজন ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
কোনো ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন হলে এতে তার মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সাড়া দেয়। ফলে সে নানারকম অস্বাভাবিক ও অবাস্তব অভিজ্ঞতা পায়। যেমনঃ মস্তিষ্কের প্রাইমারি ভিজুয়াল কর্টেক্স Cerebral এর Perceptual Centers সক্রিয় হয়, মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটনিনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়াও হ্যালুসিনেশন হলে এটি মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক ও অবাস্তব সিগন্যাল পাঠায়, যার ফলে বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে একটি বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, হ্যালুসিনেশন নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি বিভিন্ন মানসিক রোগের লক্ষণ। হ্যালুসিনেশন নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি অন্যান্য মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, পার্কিনসন্স ডিজিজ, ইত্যাদির অন্যতম লক্ষণ হতে পারে।
এটি নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে মানুষের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, যার ফলে বিভিন্ন মানসিক রোগ নির্ণয় ও সেগুলোর সঠিক চিকিৎসা আরো সহজ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া হ্যালুসিনেশন নিয়ে আমাদের সমাজে যে ভ্রান্ত ধারনা প্রচলিত আছে তা দূর করা সম্ভব। পাশাপাশি হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা সম্ভব।
এটি হলো মূলত আমাদের ৫টি ইন্দ্রীয়ের অস্বাভাবিক ও অবাস্তব অনুভূতি। সে কারণে হ্যালুসিনেশনকে প্রধানত ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ দৃষ্টিজনিত, শ্রবণজনিত, ঘ্রাণজনিত, স্পর্শজনিত ও স্বাদজনিত হ্যালুসিনেশন।
এ ধরনের হ্যালুসিনেশন হলে ব্যক্তি তার আশেপাশে অবাস্তব কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে দেখতে পান। অতিরিক্ত ড্রাগ বা অ্যালকোহল গ্রহণ, সিজোফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়ার কারণে মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্সে সমস্যা দেখা দেয়, যার ফলে ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন দেখা দেয়।
এই ধরনের হ্যালুসিনেশনে আক্রন্ত ব্যক্তি প্রায়শই কোনো অবাস্তব ও অস্বাভাবিক শব্দ, কণ্ঠস্বর শুনতে পান। এটা হতে পারে তার পরিচিত কোনো মৃত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, প্রিয়জনের গলার আওয়াজ। এটি সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা বিষণ্ণতার সাথে সম্পর্কিত। শ্রবণজনিত হ্যালুসিনেশন আমাদের দৈনন্দিত কাজে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটায় ও মানসিক অশান্তি বাড়ায়।
ঘ্রাণজনিত হ্যালুসিনেশন সাধারণত টেম্পোরাল লোবের অস্বাভাবিকতার কারণে ঘটে, যা মৃগী, পারকিনসন্স ডিজিজ বা টিউমারের ক্ষেত্রে হতে পারে। এই ধরনের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি অবাস্তব গন্ধ অনুভব করেন, যা বাস্তবে নেই। উদাহরণস্বরূপ, মৃগী রোগীরা প্রায়ই পোড়া গন্ধ বা রাবার গন্ধ অনুভব করেন। এটি রোগীর মস্তিষ্কের গন্ধজনিত অনুভূতিতে অসামঞ্জস্যতার কারণে হয়ে থাকে।
স্পর্শজনিত হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন কিছু অনুভব করেন যা বাস্তবে তাদের শরীরে বা আশেপাশে নেই। এটি স্নায়বিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। যেমনঃ পারকিনসন্স ডিজিজ, ডেলিরিয়াম ট্রমেনস এবং আরো কিছু মানসিক রোগ। এটি উদ্বেগ বা কিছু মাদকের প্রভাবেও সৃষ্ট হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ত্বকের ওপর পোকা হাঁটছে বা শরীরে কিছু ধরা হচ্ছে বলে মনে হওয়া।
স্বাদজনিত হ্যালুসিনেশনে সাধারণত টেম্পোরাল লোবের সমস্যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন স্বাদ অনুভব করেন যা তিনি কোনো খাবারের মাধ্যমে পাননি। এটি সাধারণত কিছু মানসিক রোগের সাথে জড়িত, যেখানে অস্বাভাবিক বা তিক্ত স্বাদ অনুভূত হয়। যেমন ডিমেনশিয়ার রোগীরা কখনও কখনও এই ধরনের স্বাদ অনুভব করেন।
নানান কারণে Hallucination হতে পারে। আমরা অনেকেই জানি না, আসলে হ্যালুসিনেশন কেন হয়। এ সম্পর্কে অনেকের মাঝেই ভ্রান্ত ধারণা থাকে। আর তা দূর করতে হ্যালুসিনেশনের কিছু সাধারণ কারণ সম্পর্কে জানবো।
আমাদের মস্তিষ্কে Dopamine, Serotonin, Gamma-aminobutyric acid (GABA) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ Neurotransmitter এর ভারসাম্যহীনতার কারণেই মূলত হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্রেইনে ডোপামিনের অতিরিক্ততার কারণে ব্যক্তি বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে অবাস্তব জিনিস শুনতে বা দেখতে পারেন। আবার সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মাঝে ডোপামিনের এই ধরনের ভারসাম্যহীনতা প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়।
সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, এবং মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক রোগের সাথে হ্যালুসিনেশন জড়িত থাকতে পারে। আর এসব রোগের লক্ষণ হিসেবে রোগীর হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
এই ধরনের রোগে আক্রান্তরা প্রায় সময়ে অবাস্তব বস্তু দেখতে পায়, অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং এবং অস্বাভাবিক অনুভব করে।
কিছু কিছু ওষুধ এবং মাদকদ্রব্য আছে যেগুলো মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত শক্তিশালী প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে হ্যালুসিনেশনের হতে পারে। যেমনঃ কোকেন, এলএসডি, মারিজুয়ানা ইত্যাদির মতো ভয়ঙ্কর মাদক গ্রহণের কারণে ব্যক্তির মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, অস্বাভাবিক অনুভব করে এবং বাস্তবতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
অতিরিক্ত ও অনিয়মিত মদ্যপান, মাদকদ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার সময় মাদকাসক্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক অনুভব করে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে, যা অনেক সময় হ্যালুসিনেশনের কারণে হয়ে থাকে।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যা স্নায়ুতন্ত্রে নানাধরনের সমস্যা তৈরি করে। দীর্ঘদিন যাবৎ Sleep Deprivation এর ফলে মাথা ও চোখ ব্যাথা হতে পারে এবং মস্তিষ্ক অবাস্তব চিত্র বা শব্দ অনুভব করতে পারে। যেমনঃ পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে বা অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকলে কেউ ছায়া দেখতে পারেন আবার কণ্ঠস্বর শুনতে পারেন, যা আসলে বাস্তব নয়।
বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল সমস্যা যেমন Parkinson’s disease, Alzheimer’s disease বা মৃগী রোগের লক্ষণ হিসেবেও মানুষের হ্যালুসিনেশন হতে পারে। এগুলো মস্তিষ্কজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে যা আমাদের ইন্দ্রীয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।
এর বাইরে কিছু কারণে মানুষের Hallucination হতে পারে।
মস্তিষ্কে একাধিক স্নায়বিক প্রক্রিয়ার জটিল পরিবর্তনের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন ঘটে, যা ইন্দ্রিয় সংকেত এবং বাস্তবতার উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে। নিচে হ্যালুসিনেশনের কার্যপ্রণালীর বিভিন্ন উপাদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো।
আপাতদৃষ্টিতে Hallucination এর প্রভাব ওতটা জটিল মনে না হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, কর্মজীবন থেকে শুরু করে সবখানে এটি খারাপ প্রভাব ফেলে।
হ্যালুসিনেশন মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি তীব্র আতঙ্ক ও উদ্বেগ অনুভব করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে হ্যালুসিনেশন মানসিক অবস্থা আরও খারাপ করে এবং বিষণ্ণতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যা আরও বেশি প্রকর হয়।
হ্যালুসিনেশনে ভোগা ব্যক্তি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে যা পারিবারিক ও কর্মজীবনে খারাপ ফলাফল বয়ে আনে। অনেক সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ বুঝতে না পেরে দূরত্ব সৃষ্টি করেন, কাজের জায়গায় এবং বন্ধুমহলেও ব্যক্তির সমস্যা সৃষ্টি হয় সেজন্য হ্যালুসিনেশন থেকে বাঁচতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
হ্যালুসিনেশন একটি মানসিক সমস্যা। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। নিচে হ্যালুসিনেশন থেকে বাচার উপায় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো।
হ্যালুসিনেশনের কারণ ও মাত্রার উপরে ভিত্তি করে ডোপামিন ও সেরোটোনিন নিয়ন্ত্রণকারী কিছু ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন নিয়ন্ত্রণ করা যায় বা এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার অথবা অতিরিক্ত বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ ( যেমন রিসপেরিডন, ওলানজাপিন) এবং অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট (যেমন সেরট্রালিন) দেয়া হয়।
যেকোনো ওষুধ গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবে। অন্যথায় ভুল ওষুধ সেবনের কারণে হিতে বিপরীত হতে পারে।
হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্তি পেতে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাইকোথেরাপি। Cognitive Behavioral Therapy (CBT) মানসিকভাবে অস্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা ও ভুল ধারণা থেকে মুক্তি দিতে খুবই উপকারী।
ঢাকা ও বাংলাদেশের মধ্যে সেরা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র হচ্ছে নিরাময় হাসপাতাল। আমাদের রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আপনি যদি হ্যালুসিনেশন বা অন্যকোনো মানসিক সমস্যায় ভুগেন তাহলে আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও থেরাপি নিতে পারেন।
সঠিক জীবনধারা গঠনের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পর্যাপ্ত ঘুম, সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। মাদক ও অ্যালকোহল পরিহার এবং স্ট্রেস কমানোর পদ্ধতি (যেমন মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম) মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে খুবই কার্যকরী।
হ্যালুসিনেশন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমনঃ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিক্ষা, হ্যালুসিনেশন বা অন্যকোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের স্বরনাপন্ন হওয়া ইত্যাদি। এর পাশাপাশি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হতে হবে এবং সুস্থ জীবনযাপন করতে হবে।
আপনি নিজে বা পরিবারের কেউ হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হলে ভয় পাওয়া বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি যথাযত চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যাটি রয়েছে এবং বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা এটি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করছে। থেরাপির পাশাপাশি বিভিন্ন ওষুধ সেবনের মাধ্যমেও এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সুতরাং প্যানিকড হওয়ার প্রয়োজন নেই।
উত্তরঃ না, হ্যালুসিনেশন সবসময় মস্তিষ্কের সমস্যা নির্দেশ করে না বরং এটি মাঝেমাঝে ঘটে থাকে।
উত্তরঃ কখনও কখনও আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে যে তার অভিজ্ঞতাটি বাস্তব নয় আবার কখনও তিনি জানেনই না যে যে তার অভিজ্ঞতাটি বাস্তব নয়।
উত্তরঃ হ্যাঁ, শিশুদের মধ্যেও হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
উত্তরঃ অতিরিক্ত ক্যাফেইন যুক্ত খাবার, অ্যালকোহল ও মাদকদ্রব্য গ্রহণের কারণে হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
উত্তরঃ হ্যালুসিনেশন নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য কিনা তা নির্ভর করে এরা মাত্রা ও কারণের উপরে।