আমাদের সবারই বিভিন্ন কারণে মন খারাপ হয়ে থাকে। কিন্তু তা যদি বার বার ঘটে এবং কোন কারণ ছাড়াই দীর্ঘক্ষণ মন খারাপ থাকে তাহলে তা একটু চিন্তারই বিষয়।
কেননা কোন কারণ ছাড়া ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন স্বাভাবিক কিছু নয়। এই সমস্যাটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মুড সুইং বলে।
অনেক ক্ষেত্রে মুড সুইং একটি মানসিক সমস্যা বিবেচিত হয়। তবে এর জন্য চিকিৎসাও করাতে হতে পারে। আসুন আজকের লেখায় মুড সুইংয়ের কি এবং কেন হয় তার আদ্যোপান্ত জেনে নিই।
মুড সুইং মানে হল ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন। আপনার যখন কোন কারণ ছাড়া বা কারণ বশত দীর্ঘ সময় মন খারাপ থাকে, কিংবা বার বার মন মেজাজের পরিবর্তন ঘটে তখন সেটাকে মুড সুইং বলা হয়।
এই মুড সুইং দিন বা রাতের ভিতরে বার বার ঘটতে পারে। অনেক সময় শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যার কারণেও এটা হতে পারে।
তবে এই সমস্যা যদি দীর্ঘ দিন ধরে ঘটে থাকে, তাহলে তা মানসিক সমস্যা বলে বিবেচিত হবে এবং তার চিকিৎসাও লাগতে পারে।
বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে, যদি শুরুর দিকেই মুড সুইং সমস্যার সমাধান না করা যায়, তবে তা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো জটিল এবং গভীর মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।
অনেক সময় বিভিন্ন কারণে মুড সুইং বা মন খারাপ হতে পারে। আবার শারীরিক কিংবা মানসিক কোন রোগের ফলেও এটা হতে পারে। এছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক কিংবা স্বাস্থ্যগত কোন কারণেও এটা হতে পারে।
সাধারণত দেহের হরমোন নিঃসরণের তারতম্যের ফলে মুড সুইং হতে পারে।
এছাড়াও মানসিক চাপ, অবসাদ বা হতাশা, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, মদ্যপান, ঘুমের অভাব, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মেনোপজ ও পেরিমেনোপজ ইত্যাদি থেকেও মুড সুইং দেখা দিতে পারে।
এই মুড সুইং সম্পর্কে ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লিন্ডা সমদ্দার বলেন যে, “মূলত হরমোনের প্রভাব, পুষ্টিহীনতা, লৌহ, ভিটামিন ও খনিজের অভাবে মেজাজের দ্রুত ওঠা-নামা হয়ে থাকে।”
আবার অনেকসময় মুড সুইংয়ে হওয়া অতিরিক্ত রাগ কিংবা নেতিবাচক অনুভূতির কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই সমস্যা বাড়তে থাকলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মুড সুইং হলে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-
একটি গবেষণায় জানা গেছে যে, নারীরা বেশি মুড সুইংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসিকের আগে, পড়ে কিংবা পিরিয়ডের সময় হরমোন চেঞ্জের কারণে মন-মেজাজ পরিবর্তন হয়ে থাকে।
মূলত বিভিন্ন কারণে মেয়েদের মুড সুইং দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও মহিলাদের মুড সুইংয়ের কিছু লক্ষণ হল- অধিকাংশ সময় বিষণ্ণতা বোধ করা, ঘুমাতে ও খেতে সমস্যা হওয়া, দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, দ্রুত আবেগীয় পরিবর্তন ঘটা ইত্যাদি।
অনেকসময় মহিলাদের পিরিয়ডের সময় অনেক বেশি মুড সুইং হয়ে থাকে। মূলত মহিলাদের মুড একটি নিদৃষ্ট প্যাটার্নে বদলিয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে মেয়েদের পিরিয়ড সাইকেলে হরমোনাল পরিবর্তনকে সেই সময়ের মুড চেঞ্জের জন্য দায়ী করা হয়। কেননা পিরিয়ডের সময় মহিলারা এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেন।
এই সময় মহিলাদের মানসিক চাপের মধ্যে থাকার দুটি কারণ হল- পিরিয়ড সম্পর্কিত অস্বস্তি সম্পর্কে বেশি চিন্তা করা এবং প্রিম্যানস্ট্রুয়াল সিনড্রোম অর্থাৎ পিএমএস।
মূলত প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমকে টেনশন পিএমটিও বলা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এই সময় নারীদের স্তন ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা, কোমরে ব্যথা, পেট ফাঁপা, ক্ষুধামন্দা এবং বিশেষ কোনও খাবার খাওয়ার প্রতি ইচ্ছা হয়ে থাকে।
এছাড়াও তখন মেয়েদের ত্বকে ব্রণ, উত্তেজনা, ক্লান্তি, অনিদ্রা, দুর্বলতা, বিষণ্নতা এবং মেজাজ পরিবর্তনের লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
গর্ভধারণকালীন সময়ে নারীদের নানা শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। ফলে এই সময় তাদের সামান্য কারণেও মন খারাপ হয়ে থাকে।
মূলত গর্ভাবস্থায় মহিলাদের হরমোনে পরিবর্তনের ফলে, তা মুড সুইংয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক্ষেত্রে আকস্মিক কান্না, হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, আবার কোন কিছু নিয়ে আনন্দিত কিংবা উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখা যায়।
প্রায় প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলারাই এই রকম অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান। আর এ ধরনের মুড সুইং সাময়িক এবং গর্ভাবস্থার জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়।
তবে গর্ভকালীন সময়ে মুড সুইংয়ের কারণে যদি আপনি বিষণ্ণতা বোধ করেন, ঘুমাতে সমস্যা হয়, খেতে অরুচি হয়, দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং তা যদি ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাড়তে থাকে, তাহলে মানসিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
অনেক সময় পুরুষদেরও মুড সুইং ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে আপনাকে বুঝতে হবে যে, মুড সুইং কি, কেননা এই মেজাজের পরিবর্তন নারী-পুরুষ সবারই ঘটতে পারে।
সেক্ষেত্রে জীবনযাত্রা, কাজের চাপ, মানসিক অবসাদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিষয়ের কারণেও মন মেজাজের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
মূলত টেস্টোস্টেরন পুরুষদের প্রজনন হরমোন। আর এই হরমোন ছেলেদের প্রজনন কাজের জন্যই না বরং আরো বিভিন্ন আবেগীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ফলে এটি বাড়া অথবা কমার কারণে তাদের আচার আচরণে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
সুতরাং এর ফলে তাদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়, তা হল-ক্লান্তিবোধ, বিভ্রান্তি বা কনফিউশান, হতাশা, মন খারাপ থাকা, অতিরিক্ত রাগ, অযথা বিরক্তি, উদ্বেগ বা চিন্তা, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, যৌন চাহিদা কমে যাওয়া, আচরণগত অসমঞ্জস্যতা ইত্যাদি।
এছাড়াও এই লক্ষণগুলো যদি কারো ভিতর দীর্ঘ সময় ধরে দেখা দেয়, তাহলে তার অবশ্যই মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়া উচিত।
এই মুড সুইং কি তা বুঝে নিয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কেননা আপনার ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন কেন ঘটছে, তা জেনে চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে দ্রুত সুস্থ হতে পারবেন। সুতরাং আপনি যেভাবে মুড সুইং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন-
১. আপনাকে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। সেক্ষেত্রে দৈনিক অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। কেননা মানসিক চাপ কমানোর জন্য সঠিক ঘুম অত্যন্ত জরুরী।
২. প্রতিদিন আপনাকে ৩ থেকে ৪ লিটার পানি পান করতে হবে। কেননা মন মেজাজ পরিবর্তনের সমস্যা এড়াতে হাইড্রেটেড থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বেশি করে পানি পান করলে দেহে উপস্থিত টক্সিন সহজেই বেরিয়ে যায়।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম এবং মেডিটেশন করতে হবে । মন মেজাজ উন্নত করার ক্ষেত্রে ব্যায়াম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকার পাশাপাশি দেহে হরমোনের ভারসাম্যও ঠিক রাখে।
৪. স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলতে হবে। এছাড়াও খাদ্য তালিকায় অল্প চিনি এবং কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা তা মুড সুইংয়ের সমস্যা উপশমে দারুণ সহায়তা করে।
৫. আপনার মুড সুইং এড়াতে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে যেতে পারেন। এছাড়াও মন মেজাজের উন্নতি ঘটাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডাও দিতে পারেন।
৬. আপনি সময় সুযোগ পেলে বিভিন্ন খেলাধূলা করতে পারেন। কেননা এতে আপনার মন খারাপ অনেকটাই দূরীভূত হবে।
৭. আপনার ধূমপান কিংবা মদ্যপানের বদভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। কেননা তা আপনার মন মেজাজের অবনতি ঘটাতে পারে।
৮. এই ক্ষেত্রে শারীরিক কোন ব্যথা কিংবা মাথাব্যথার ঔষধ এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা তা আপনার মুড সুইংয়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
৯. আপনার রাতজেগে ফোন চালানোর অভ্যাস থাকলে, তা বাদ দিতে হবে। কেননা তা আপনার মন মেজাজের অবনতি ঘটাতে পারে।
১০. মুড সুইংয়ের সময় আপনাকে সুষম খাদ্যতালিকা মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে সেই সময় নিজেকে খুশি করতে চকলেট, চিপস, জুস ইত্যাদি খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও পিরিয়ডের সময় মন খারাপ এড়াতে পছন্দ সই খাবার খাওয়া যেতে পারে।
১১. আপনার মন মেজাজের উন্নতি ঘটাতে এবং মানসিক চাপ এড়াতে ধর্মীয় প্রার্থনা
করতে পারেন।
১২. আপনার মুড সুইং কাটাতে প্রয়োজন পড়লে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের আওতায় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এমনকি দরকার পড়লে কাউন্সিলিং করতেও হতে পারে। তাই, মুড সুইংয়ের সুচিকিৎসার জন্য নিরাময় হাসপাতালের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
আমরা যদি মুড সুইং কি তা বুঝতে পারি, তবে তার সমাধানও করতে পারবো। অনেক সময় হয়তো পুরোপুরি না হলেও, তা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে কাজের অতিরিক্ত চাপ, পারিবারিক সমস্যা, ব্যক্তিগত ঝামেলা, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদির কারণে মুড সুইং দেখা দেয়।
তাই, এই মন মেজাজের সমস্যাটি খুব বেশি পরিমাণে দেখা দিলে, তৎক্ষণাৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন।