|

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের কীভাবে বিরত রাখা যায়

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের কীভাবে বিরত রাখা যায়

মাদকের ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ দেশের সোনালি এক প্রজন্ম। যে প্রজন্মের সময় কাটতো বিদ্যালয়ের বারান্দায়, বন্ধুদের আড্ডায় থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ খেলার মাঠে।ওরা বড় হয়ে উপহার দিতো এক সোনালি বাংলাদেশ।

অথচ, স্বপ্নের মতো সেই প্রজন্ম আজ মাদকের ভয়াল থাবায় নাস্তানাবুদ! ভয়াল এই থাবা প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ যেমন করছে অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি ধুঁকে ধুঁকে ছিন্ন করছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য!

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী! বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।

এখন পত্রিকার পাতা খুললেই চোখ পড়ে মাদকাসক্তদের উৎপাতে কোথাও না কোথাও আক্রান্ত হওয়ার খবর।মাদকাসক্ত ছেলে-মেয়ের হাতে মা-বাবা খুন হওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা এখন তো নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। ২০১৩ সালের আলোচিত মাদকাসক্ত কিশোরী ঐশীর হাতে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মা নির্মমভাবে খুন হওয়ার ঘটনা এখনও কেউ ভুলে নি।

শহর থেকে গ্রামাঞ্চল, সবখানেই মাদকের ভয়াল আগ্রাসন! দুর্লভ নেশার দ্রব্য এখন হাতের নাগালেই পাওয়া যায় । ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক শৃঙ্খলা, মানবিক সম্প্রীতি ও পারিবারিক বন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো না থাকায় মাদকের ভয়াল আগ্রাসন মাথাচাড়া দিচ্ছে চারদিকে! সরকারি ও বেসরকারি নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে শিশু কিশোরদের মাদক থেকে বিরত রাখা অনেকাংশে সম্ভব হবে।

মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ

পরিসংখ্যান বলছে, শৈশব ও কৈশোরকালে মাদকের প্রতি ঝোঁক থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এই সময়টা জীবনের একটা উত্তরকালীন পর্যায়। আর, তখনই দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে। বন্ধুদের চাপ কিংবা প্রলোভনে তখন মাদক নেওয়া শুরু হয়।

শুরুতেই আসক্তি সামান্য পর্যায় থাকলেও একটাসময় এসে নির্ভরশীলতা এতটাই তৈরি হতে থাকে যে মাদক ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে পারে না ।

তাই, মাদকের ভয়াল এই থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখতে, সবার আগে শিশু-কিশোরদের মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন।

১. পারিবারিক অবস্থা

মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে শিশু-কিশোরদের পারিবারিক অবস্থা খুবই প্রভাব ফেলে। জরাজীর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পারিবারিক নিয়মের অভাবের ফলে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা মাদকের প্রতি ঝুঁকতে থাকে।

মাঠ পর্যায়ের পরিসংখ্যান বলছে, বস্তিপাড়ায় বসবাস করা ৯০ শতাংশ শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুনী এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা মাদকাসক্ত। এছাড়াও, পরিবারের কোনো সদস্য কোনোভাবে মাদকের সাথে যুক্ত হলে পরিবারের অন্যদের এর প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

২. সঙ্গদোষ

একটা শিশু বেড়ে উঠার পথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার বন্ধু এবং যাদের সাথে ওঠাবসা হয় প্রতিনিয়ত। অনেক সময় মাদকাসক্ত বন্ধুদের কু-প্রভাবেও ভালো ও মেধাবী শিশুকিশোর অসৎ সঙ্গে পড়ে মাদক সেবনের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হচ্ছে এবং মাদক সেবন করছে।

জরিপও বলছে মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত হয় সঙ্গদোষে। একটি জাতীয় দৈনিকের ২০১৯ এর জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ২৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশু-কিশোর বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদকাসক্ত হয়েছে।

৩. সহজলভ্যতা

শিশুকিশোর থেকে শুরু করে তরুন প্রজন্মের মধ্যে মাদকের মতো ভয়াল থাবা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান আরেকটি কারণ হচ্ছে এর সহজলভ্যতা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মফস্বল শহর, দেশের প্রায় প্রতিটা প্রান্তরে সিগারেট থেকে শুরু করে হেরোইন, মদ, ফেন্সিডিলের মতো ছোট, বড় ও মাঝারি সবধরনের ভয়াবহ মাদক সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

পাশাপাশি এর মূল্যও অনেকটাই হাতের নাগালে। ফলশ্রুতিতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সকল বয়সী ব্যক্তি মাদকের প্রতি সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ছে।

৪. হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ

হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থেকে মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা শিশু-কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে। অল্প বয়সে সর্ম্পকে জড়ানো এরপর বিচ্ছেদ, পারিবারিক অশান্তির পর ধারণা জন্ম নেয় এমন, হতাশা থেকে কাটিয়ে মাদক হতে পারে শ্রেষ্ঠ কিছু।

এরপর, মাদক সেবনের মাত্রা ধীরে ধীরে যখন বাড়তে থাকে তখন সেটা আসক্তি অবধি চলে যায়, এরপর আর এই আসক্তি থেকে বের হতে পারে না।

৫. কৌতূহলবশত

অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কৌতূহলবশত মাদক সেবনের বিষয়টা সবচেয়ে বেশি থাকে। নিজেদের স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এই ভেবে প্রথমে অল্প অল্প মাদক সেবন শুরু করে। একপর্যায়ে যখন তা আসক্তি অবধি চলে আসে তখন তা আর কাটিয়ে উঠতে পারে না।

মাদকের ভয়াবহতা

মাদকের ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠে দেশে মাদকের ব্যাপ্তির তথ্যে দিকে চোখ বোলালে। গবেষণা বলছে, মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর, মাদকের মাধ্যমে অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি দিনে গড়ে ১০০ টাকা মাদকের জন্য ব্যয় করে। সারা বাংলাদেশে দিনে মাদকদ্রব্য কেনায় যে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা। মাসিক তা দাড়ায় ২১০০ কোটি টাকা এবং বছরে গিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

মাদকের এই ব্যাপ্তিই বলে দেয় মাদকের ভয়াবহতার অবস্থা ঠিক কোথায় পৌঁছালো! মাদকের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংসের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য! মাদক সেবনের ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এতে করে স্মৃতি, মনোযোগ, এবং শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

এছাড়াও হৃৎস্পন্দন এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এতে করে অল্প বয়স থেকে হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, এবং হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। উদ্বেগ, বিষণ্নতা, মানসিক বিভ্রম ও আত্মহত্যার প্রবণতায় মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে।

যেভাবে মাদক থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখা যায়

গ্রাম থেকে শহর মাদক ভয়ংকর আকারের চিত্র ফুটে উঠেছে সবখানে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত শুধু কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা কিশোর ও তরুণের সংখ্যা ছিল ৬৯ শতাংশ। অথচ, ২০১৫ থেকে ২০১৮ তে যে সংখ্যাটা ছিল ৫৯ শতাংশ।

এতেই সহজেই অনুমিত হওয়া যায়, কিশোর-তরুণদের মধ্যে মাদকের ভয়াল থাবায় জড়িয়ে পড়ার মাত্রা হু হু করে বাড়ছে। তাই এখনই সময়, মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখার। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখতে যে-সব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

১. পারিবারিক সচেতনতা

একটা শিশু জন্মের পর সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় তার পরিবারে। পরিবারই তার সামাজীকিকরনের প্রথম ধাপ এবং অন্যতম মাধ্যম। শিশুর বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবন এবং পরবর্তী সময়টাতেও পরিবারের প্রভাব টিকে থাকে। আর তাই, শিশু-কিশোরদের মাদক থেকে বিরত রাখার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে পরিবার।

সন্তানরা কি শিখছে, কি দেখছে, কি নিচ্ছে, কার সাথে বেড়ে উঠছে এই সব কিছু পর্যবেক্ষণে রাখাটা পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব। যে-সব পরিবারে বাবা-মা থাকে না কিংবা বাবা-মা থেকে যথেষ্ট পরিচর্যা পায় না সেসব পরিবারের সন্তানদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়।

২. বন্ধু নির্বাচনে সচেতনতা

পরিবারের পরই একটা শিশুর সামাজিকীকরনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তার বন্ধুবান্ধব। পরিবারের পরই বন্ধুবান্ধবদের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় শিশু-কিশোররা। পরিসংখ্যান বলছে, শিশু-কিশোরদের মাদকে আসক্ত হওয়ার পিছনে অন্যতম ভূমিকা রাখে সঙ্গদোষ।

আর, তাদের থেকে প্ররোচিত হয়ে মাদকে আসক্ত হওয়ার পর্যায়টা শুরু হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনে সর্বদা সতর্ক থাকা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে পরিবার এই বন্ধু নির্বাচনে শুরু থেকে নানানভাবে সন্তানদের অবহিত করতে পারে।

৩. সামাজিক উদ্যোগ

সামাজিক উদ্যোগ মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুর জন্মের পর থেকে সমাজেই তার বড় হওয়া, সমাজের আচার কানুন ও নানাবিধ উদ্যোগ তার আচরণ ও নানান ক্ষেত্রে বিবিধ প্রভাব ফেলে। তাই, মাদক নিয়ে সামাজিক নানা উদ্যোগ, প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শিশু-কিশোরদের মাদকের পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত রাখতে পারে।

৪. সরকারি উদ্যোগ

মাদকের ভয়াল থাবায় যখন জর্জরিত পুরো একটি প্রজন্ম, তখন সরকারি ইমিডিয়েট উদ্যোগ মাদক থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সর্বস্তরে মাদকের অতি সহজলভ্যতা মাদকের বিস্তার রোধের প্রধান একটি অন্তরায় বলে বিবেচিত।

যেখানে, মাত্র ২০-৩০ টাকার মধ্যেই স্বল্প পর্যায়ের মাদকের দেখা মিলছে। এক্ষেত্রে সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ এর মাধ্যমে মাদক চোরাচালানকারী, মাদকাসক্ত থেকে শুরু মাদকের সাথে কোনোভাবে জড়িয়ে যাওয়া সকলকে কঠোর বিচারিক আওতায় আনার মাধ্যমে মাদকের বিস্তার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।

সর্বোপরি বলা যায় মাদকের ভয়াল থাবা থেকে শিশু-কিশোরদের বিরত রাখতে উপরোক্ত গুরত্বপূর্ন বিষয়গুলোর পাশাপাশি, মাদকের ক্ষতিকর দিক, মাদকাসক্ত হওয়ার পরবর্তী জীবন বিষয়ক নানাবিধ সচেতনমূলক কর্মকাণ্ডগুলো আগামীর প্রজন্মকে এর ভয়াল থাবা থেকে বিরত রাখতে পারে।

BOOK APPOINMENT