|

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার: এটি কী এবং কীভাবে মোকাবিলা করবেন

জীবনের পথে চলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হই যা আমাদের মনের গভীরে দাগ কেটে যায়। একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের হঠাৎ মৃত্যু, বা কোনো নির্মম অভিজ্ঞতা আমাদের মানসিক শান্তি কেড়ে নিতে পারে। 

আপনি কি কখনো এমন অবস্থার মধ্যে পড়েছেন যেখানে অতীতের কোনো ঘটনা বারবার আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে? আপনি কি সেই মুহূর্তগুলো আবার যেন নতুন করে বেঁচে উঠছেন বলে মনে করেন? এটি হতে পারে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) নামক একটি মানসিক সমস্যার লক্ষণ।

এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কী, এর লক্ষণগুলো কী কী, কীভাবে এটি আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, কীভাবে আমরা এর থেকে মুক্তি পেতে পারি।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কী?

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা যা কোনো গুরুতর মানসিক আঘাত বা ট্রমার পরে মানুষের মধ্যে দেখা দেয়। এটি কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা চরিত্রের ত্রুটি নয়, বরং আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বা জীবন-হুমকির পরিস্থিতির পরে সৃষ্টি হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, একটি মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁচে ফেরা, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া, বা এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প বা বন্যার মতো ঘটনা এই সমস্যার জন্ম দিতে পারে।

এটি শুধু তাদের ক্ষেত্রে ঘটে না যারা সরাসরি এই ঘটনার শিকার হয়েছেন। যারা এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, যেমন একজন ডাক্তার যিনি দুর্ঘটনাস্থলে আহতদের চিকিৎসা করেছেন বা একজন সাংবাদিক যিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন, তাদের মধ্যেও ট্রমার পরবর্তী মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে PTSD-এর শিকার হয়। তবে আমাদের সমাজে এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই জানেন না যে তারা যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা আসলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। তাই এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

PTSD-এর লক্ষণগুলো কী কী?

PTSD লক্ষণ সাধারণত ট্রমার পরে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশ পায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি বছরের পর বছর ধরে লুকিয়ে থাকতে পারে এবং হঠাৎ করে কোনো ট্রিগারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে। এই লক্ষণগুলোকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যা আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে।

  1. অতীতের ঘটনা পুনরায় অনুভব করা:
    • ফ্ল্যাশব্যাক: হঠাৎ করে মনে হয় যেন আপনি সেই ভয়ানক মুহূর্তে ফিরে গেছেন।
    • দুঃস্বপ্ন: রাতে ঘুমের মধ্যে ট্রমার দৃশ্য বারবার দেখা।
    • ট্রিগার: কোনো শব্দ (যেমন গাড়ির হর্ন), গন্ধ (যেমন ধোঁয়া), বা দৃশ্য (যেমন ভিড়) আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে।
  2. ট্রিগার এড়িয়ে চলা:
    • আপনি সেই জায়গা, মানুষ, বা এমনকি কথোপকথন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন যা ট্রমার কথা মনে করিয়ে দেয়।
    • উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যিনি বন্যায় সব হারিয়েছেন, তিনি বৃষ্টির শব্দ শুনলেই অস্থির হয়ে পড়তে পারেন।
  3. মানসিক অস্থিরতা:
    • অকারণে রাগ, উদ্বেগ, বা অপরাধবোধে ভোগা।
    • ঘুমের সমস্যা, যেমন ঘুম না আসা বা ঘুমের মধ্যে ঘন ঘন জেগে ওঠা।
    • মনোযোগ হারানো বা দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ কমে যাওয়া।
  4. শারীরিক প্রতিক্রিয়া:
    • দ্রুত হৃদস্পন্দন, অতিরিক্ত ঘাম, বা শারীরিক ক্লান্তি।
    • কখনো কখনো মাথাব্যথা বা পেটের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

এই PTSD লক্ষণ যদি এক মাসের বেশি সময় ধরে থাকে এবং আপনার জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, তবে এটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। যেমন, একজন ব্যক্তি যিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, তিনি গাড়িতে উঠতে ভয় পেতে পারেন বা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন।

মানসিক আঘাতের কারণ

মানসিক আঘাত বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এটি এমন কোনো ঘটনা যা একজন ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, জীবন-হুমকির, বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হয়। কিছু সাধারণ কারণের মধ্যে রয়েছে:

  • শারীরিক বা যৌন নির্যাতন: শৈশবে বা বয়ঃসন্ধিকালে এমন অভিজ্ঞতা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। যেমন, যারা শৈশবে নির্যাতিত হয়েছেন, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতে পারেন।
  • যুদ্ধ বা সন্ত্রাসী হামলা: সৈনিক, শরণার্থী, বা সাধারণ নাগরিক যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন, তাদের মধ্যে PTSD বেশি দেখা যায়।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, ভূমিকম্প, বা ঝড়ে ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারানো। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণ, এটি একটি বড় কারণ হতে পারে।
  • প্রিয়জনের হঠাৎ মৃত্যু: কোনো দুর্ঘটনা বা নৃশংসভাবে কাউকে হারালে মানসিক আঘাত গভীর হয়।

প্রত্যেকের মানসিক শক্তি ও সহনশীলতা আলাদা। একটি ঘটনা যা একজনের জন্য সামান্য চাপের মনে হতে পারে, তা অন্যজনের জন্য গভীর ট্রমার পরবর্তী মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ট্রমার পরবর্তী মানসিক চাপ কীভাবে প্রভাব ফেলে?

ট্রমার পরবর্তী মানসিক চাপ আমাদের শরীর ও মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। যখন আমরা কোনো ভয়ানক ঘটনার সম্মুখীন হই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক “ফাইট অর ফ্লাইট” মোডে চলে যায়—অর্থাৎ, হয় লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়, নয়তো পালানোর জন্য। PTSD-তে এই প্রতিক্রিয়া বারবার ঘটে, এমনকি বিপদ কেটে গেলেও। এর ফলে:

  • দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়: কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, সামাজিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি, বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে অসুবিধা।
  • শারীরিক সমস্যা: দীর্ঘমেয়াদী চাপের কারণে মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, হজমের সমস্যা, বা এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • মানসিক অবসাদ: একাকীত্ব, হতাশা, বা জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।

উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছেন, তিনি হঠাৎ জোরে শব্দ শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন। এমনকি তিনি বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পেতে পারেন, যা তাদের জীবনকে স্বাভাবিকভাবে চালানো কঠিন করে তোলে। এই প্রভাব শুধু ব্যক্তির উপর নয়, তাদের পরিবার ও সমাজের উপরও পড়ে।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার চিকিৎসার উপায়

সুসংবাদ হলো, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার চিকিৎসা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেশ কিছু কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  1. থেরাপি:
    • কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): এটি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও ভয়কে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন থেরাপিস্ট আপনাকে শেখাতে পারেন কীভাবে ট্রিগারের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করবেন।
    • আই মুভমেন্ট ডিসেন্সিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং (EMDR): এটি ট্রমার স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণে বিশেষভাবে কার্যকর। এই পদ্ধতিতে চোখের নড়াচড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সাহায্য করা হয় ভয়কে কমাতে।
  2. ওষুধ:
    • উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা কমাতে ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিউপটেক ইনহিবিটর (SSRI) PTSD-এর জন্য সাধারণত ব্যবহৃত হয়।
  3. সাপোর্ট গ্রুপ:
    • একই ধরনের অভিজ্ঞতার মানুষের সঙ্গে কথা বলা মানসিক শক্তি বাড়ায়। এটি আপনাকে বোঝতে সাহায্য করে যে আপনি একা নন।

চিকিৎসা শুরু করার আগে একজন মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকের অবস্থা আলাদা হতে পারে, তাই চিকিৎসার ধরনও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, কারো জন্য থেরাপি যথেষ্ট হতে পারে, আবার কারো জন্য ওষুধের সঙ্গে থেরাপির সমন্বয় প্রয়োজন।

PTSD থেকে মুক্তির সহজ উপায়

পেশাদার চিকিৎসার পাশাপাশি, আপনি নিজেও কিছু সহজ পদক্ষেপ নিয়ে PTSD থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেতে পারেন। এই পদ্ধতিগুলো আপনার দৈনন্দিন জীবনে সহজেই প্রয়োগ করা যায়:

  • মাইন্ডফুলনেস বা সচেতনতা: গভীর শ্বাস নেওয়া, ধ্যান, বা যোগব্যায়াম মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন সকালে ৫ মিনিট গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস আপনার উদ্বেগ কমাতে পারে।
  • প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা: আপনার অনুভূতি বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করলে মানসিক বোঝা অনেকটাই হালকা হয়।
  • নিয়মিত রুটিন: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো, খাওয়া, এবং হালকা ব্যায়াম করা শরীর ও মনকে সুস্থ রাখে। যেমন, প্রতিদিন ১৫ মিনিট হাঁটা আপনার মেজাজ ভালো রাখতে পারে।
  • ট্রিগার চিহ্নিত করা: কী আপনাকে অস্থির করে তা বোঝার চেষ্টা করুন এবং সেগুলো এড়িয়ে চলার পরিকল্পনা করুন। উদাহরণস্বরূপ, যদি ভিড় আপনাকে ভয় পাইয়ে দেয়, তবে শান্ত সময়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
  • শখের মধ্যে সময় কাটানো: গান শোনা, বই পড়া, বা বাগান করা মনকে সতেজ রাখে।

এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো দীর্ঘমেয়াদে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ধৈর্য ধরে এগুলো প্রয়োগ করলে আপনি ধীরে ধীরে নিজেকে সুস্থ মনে করবেন।

উপসংহার

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অবস্থা। সঠিক সচেতনতা, সমর্থন, এবং পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

আপনি বা আপনার কাছের কেউ যদি এই PTSD লক্ষণ-এ ভুগে থাকেন, তবে দ্বিধা না করে সাহায্য নিন। এটি হতে পারে একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা, একটি সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেওয়া, বা পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

জীবনের প্রতিটি দিনকে সুস্থ ও সুখী করে তোলার জন্য প্রথম পদক্ষেপটি আজই নিন। মনে রাখবেন, আপনি একা নন—আপনার পাশে অনেকে আছেন যারা আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

BOOK APPOINMENT