আজকের দ্রুতগতির জীবনে depression (ডিপ্রেশন) একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজের চাপ, সম্পর্কের জটিলতা, অনিশ্চয়তা কিংবা দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ—সব মিলিয়ে অনেকেই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।
একটা কথা পরিষ্কার করে বলি: ডিপ্রেশন কোনো দুর্বলতা নয়। এটা একটা চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অবস্থা, ঠিক যেমন শরীরের অন্য যেকোনো অসুখ। সঠিক বোঝাপড়া, ধৈর্য আর সহায়তা পেলে এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
এই লেখায় depression থেকে বেরিয়ে আসার ১০টি বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত উপায় সহজ ভাষায় তুলে ধরেছি, যাতে আপনি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা আর ভরসা দুটোই পান।
ডিপ্রেশন অনেক সময় একাকীত্ব আর ঘরে আটকে থাকার ফলেই বাড়ে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বাইরে হাঁটুন, পার্কে বসা বা নদীর ধারে কিছু সময় কাটানো মনের উপর সরাসরি ভালো প্রভাব ফেলে।
সূর্যের আলো শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে, যা মস্তিষ্কের সেরোটোনিন হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে। এই হরমোন আমাদের মুড ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত প্রকৃতির আশেপাশে থাকলে ডিপ্রেশনের লক্ষণ ২০–৩০% পর্যন্ত কমে যায়। শুরুটা ছোট করুন সকালে মাত্র ১০ মিনিট হাঁটা দিয়েই যথেষ্ট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদীর পাড়, খোলা মাঠ বা সবুজ এলাকা সহজেই পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে হাঁটাকে অভ্যাসে পরিণত করুন।
একাকীত্ব ডিপ্রেশনের সবচেয়ে বড় সহচর। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকা খুব জরুরি। বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলুন, একসাথে কফি খান বা পরিবারের সাথে সময় কাটান।
হাসিখুশি মানুষের সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়, যাকে ‘লাভ হরমোন’ বলা হয়। এটি বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে।
নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে চাইলে ফেসবুক গ্রুপ, লোকাল ক্লাব বা কমিউনিটি অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত হতে পারেন।
বাংলাদেশে জুমার নামাজের পর আড্ডা বা শখভিত্তিক ক্লাব যেমন ফিশিং গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগের ভালো মাধ্যম। সপ্তাহে ২–৩ দিন এমন যোগাযোগ থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং “আমি একা” অনুভূতি ধীরে ধীরে কমে যায়।
ব্যায়াম ডিপ্রেশনের জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক ওষুধ। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা, জগিং, যোগা বা সাইক্লিং করলে শরীরে এন্ডোরফিন নামক এক ধরণের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ‘হ্যাপি হরমোন’ হিসেবে কাজ করে।
এছাড়া ব্যায়াম মস্তিষ্কে BDNF প্রোটিন বাড়ায়, যা নতুন নিউরন তৈরিতে সহায়তা করে। WHO-এর গাইডলাইন অনুযায়ী, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম ডিপ্রেশন কমাতে কার্যকর।
শুরুতে ভারী কোনো ব্যায়ামের দরকার নেই।ঘরে হালকা ব্যায়াম দিয়েই শুরু করুন। সাইকেল চালানো বা নদীতে সাঁতার কাটা আনন্দদায়ক হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ৩–৪ সপ্তাহ পর ঘুম ও এনার্জিতে স্পষ্ট পরিবর্তন টের পাবেন।
খাবারের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্ক আছে। ওমেগা–৩ সমৃদ্ধ মাছ (ইলিশ, রুই), ফল, শাকসবজি ও নাটস ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি–১২ ও ডি-এর অভাব ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশি খাবারে মাছ সহজলভ্য। তাই সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন মাছ রাখুন। চিনি ও প্রসেসড খাবার কমান, কারণ এগুলো মুড সুইং বাড়ায়। সকালে ওটস বা ফলের স্মুদি দিয়ে দিন শুরু করলে সারাদিনে অনেক এনার্জি পাওয়া যায় এবং মুড ভালো রাখে।
যে কাজগুলো আপনাকে ভালো লাগায়, সেগুলোর জন্য প্রতিদিন সময় রাখুন। গান শোনা, বই পড়া, ছবি তোলা বা ফিশিং সবই কাজে আসে। এই কাজগুলো মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ করে, যা আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি তৈরি করে।
প্রতিদিন মাত্র ১৫ মিনিট হবি টাইম রাখলেও মন হালকা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীল কাজ ডিপ্রেশনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
অগোছালো জীবন ডিপ্রেশনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া ও কাজ করা মস্তিষ্ককে স্থির করে। ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম খুব জরুরি। এতে শরীরের সার্কেডিয়ান রিদম ঠিক থাকে। ছোট লক্ষ্য ঠিক করুন—যেমন আজ ৫০০০ স্টেপ হাঁটবেন। এতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি তৈরি হয়।
দুঃখের সিনেমা, স্যাড গান বা সবসময় অভিযোগ করা মানুষ মনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। সম্ভব হলে এগুলো এড়িয়ে চলুন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নেগেটিভ পোস্ট আনফলো করুন। পরিবর্তে কমেডি, অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও বা TED Talks দেখুন। এটি মনের নেগেটিভ বায়াস ভাঙতে সাহায্য করে।
প্রার্থনা, কুরআন বা গীতা পাঠ, ধ্যান কিংবা দান এসব কাজ মনের মধ্যে শান্তি ও উদ্দেশ্যবোধ তৈরি করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত আধ্যাত্মিক চর্চা ডিপ্রেশনের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।
নতুন জামা, হেয়ারকাট বা ঘর গুছিয়ে নেওয়া। ছোট পরিবর্তন হলেও বড় মনে বড় প্রভাব ফেলে। ঘরে তাজা ফুল বা আলো-বাতাস ঢুকতে দিন। এতে সেলফ-ইস্টিম বাড়ে এবং নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়।
যদি দীর্ঘদিন ঘুমের সমস্যা থাকে, কাজের আগ্রহ একেবারে কমে যায় বা চিন্তা খুব ভারী হয়ে ওঠে, তাহলে সাইকোলজিস্ট বা চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরি।
CBT থেরাপি ও প্রয়োজনে ওষুধ কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশে নিরাময় হাসপাতাল বা নিকটস্থ ভালো ক্লিনিকে যোগাযোগ করা যায়। মনে রাখবেন সাহায্য চাওয়া দুর্বলতা নয়, বরং সচেতনতার পরিচয়।
Depression থেকে বেরিয়ে আসা একটি ধীর কিন্তু সম্ভব যাত্রা। নিজেকে সময় দিন, ছোট অগ্রগতিকে মূল্য দিন এবং একা লড়াই করার চেষ্টা করবেন না। পরিবার, বন্ধু ও প্রয়োজনে চিকিৎসক সহায়তা নিলে এই পথ অনেক সহজ হয়ে যায়। আপনি একা নন সঠিক সহায়তা ও যত্নে মানসিক সুস্থতা ফিরে পাওয়া সম্ভব।