|

প্যানিক ডিজঅর্ডার কী, এর লক্ষণ, কারণ এবং এর কার্যকর চিকিৎসা

প্যানিক ডিজঅর্ডার কী, এর লক্ষণ, কারণ এবং এর কার্যকর চিকিৎসা

হঠাৎ করে বুক ধড়ফড়ানি, শ্বাসকষ্ট, দমবন্ধ লাগা—এমন অভিজ্ঞতা কি আপনার হয়েছে? মনে হয়েছে যেন এখনই কিছু একটা খারাপ ঘটবে, হয়তো আপনি মারা যাবেন? যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে আপনি একা নন। তবে, যদি এই ধরনের অনুভূতি ঘন ঘন আসে এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে, তাহলে সম্ভবত আপনি প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।

বাংলাদেশে প্রায় ৩-৫% মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন, অথচ অনেকেই জানেন না যে এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ। এই ব্লগে আমরা প্যানিক ডিজঅর্ডার কী, এর লক্ষণ, কারণ এবং এর কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্যানিক ডিজঅর্ডার (Panic Disorder) কী?

প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে ব্যক্তি বারবার হঠাৎ করে তীব্র ভয় এবং উদ্বেগের আক্রমণের শিকার হন। এই আক্রমণগুলোকে প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়। এই সময় শারীরিক এবং মানসিকভাবে চরম অস্বস্তি অনুভূত হয়, যা সাধারণত ১০-২০ মিনিট স্থায়ী হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হল, এই আক্রমণ কোন পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই যেকোনো সময়ে ঘটতে পারে, এমনকি আপনি যখন ঘুমাচ্ছেন তখনও।

প্যানিক অ্যাটাক বা তীব্র ভয় হলো Panic Disorder এর মূল বৈশিষ্ট্য। এই অ্যাটাকগুলো এতটাই ভীতিকর হতে পারে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে আবার কখন এমন হবে সেই ভয়ে আতঙ্কিত থাকেন।

প্যানিক ডিজঅর্ডার কেন হয়?

প্যানিক ডিজঅর্ডারের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানা। তবে বিজ্ঞানীরা কিছু বিষয়কে এর জন্য দায়ী করেন। যেমনঃ

  • জেনেটিক কারণঃ যদি পরিবারে কারো প্যানিক ডিজঅর্ডার থাকে, তাহলে আপনারও এটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • মস্তিষ্কের কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সঃ নিউরোট্রান্সমিটার যেমন সেরোটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিনের অসামঞ্জস্যতা এর সাথে জড়িত।
  • মানসিক চাপঃ জীবনের কোনো বড় পরিবর্তন, হতাশা কিংবা দীর্ঘকালীন মানসিক চাপ এই রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
  • ট্রমাটিক ইভেন্টঃ শৈশবে বা পরবর্তী জীবনে কোন আঘাতমূলক ঘটনা ঘটে থাকলে তা থেকে প্যানিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় প্যানিক ডিজঅর্ডার দ্বিগুণ বেশি দেখা যায়। এছাড়া ২০-৩০ বছর বয়সের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি, যদিও যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে।

প্যানিক ডিজঅর্ডার এর লক্ষণ

প্যানিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে পারে। তবে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়-

  • তীব্র বুক ধড়ফড়ানি বা হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়াঃ মনে হতে পারে যেন হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাচ্ছে বা বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে।
  • ঘাম হওয়াঃ অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে, এমনকি ঠান্ডা পরিবেশেও।
  • কাঁপুনি বা শরীর ঝাঁকুনিঃ শরীর কাঁপতে পারে বা এক ধরণের মানসিক অস্থিরতা অনুভব হতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট বা দমবন্ধ লাগাঃ মনে হতে পারে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বা দম আটকে আসছে।
  • বুকে ব্যথা বা অস্বস্তিঃ বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভব হতে পারে।
  • বমি বমি ভাবঃ পেটে খারাপ লাগা বা বমি হওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
  • মাথা ঘোরাঃ মনে হতে পারে যেন মাথা ঘুরছে বা আপনি পড়ে যাবেন।
  • অবাস্তব বা বিচ্ছিন্ন বোধঃ নিজের শরীর বা চারপাশের জগৎকে অস্বাভাবিক বা দূরের মনে হতে পারে (Derealization or Depersonalization)।
  • নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ঃ মনে হতে পারে যেন আপনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন বা পাগল হয়ে যাচ্ছেন।
  • মৃত্যু ভয়ঃ মনে হতে পারে যেন আপনি এখনই মারা যাবেন।
  • ঠান্ডা লাগা বা গরম লাগাঃ হঠাৎ করে ঠান্ডা লাগতে পারে বা গরম বোধ হতে পারে।

প্যানিক অ্যাটাকের সময় এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কয়েকটি একই সাথে দেখা দিতে পারে এবং সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে। এছাড়াও, প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই আবার আক্রমণের শিকার হওয়ার আতঙ্কে থাকেন, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কারো যদি শপিং মলে প্যানিক অ্যাটাক হয়, তিনি সেখানে যাওয়া এড়িয়ে চলতে চাইবেন।

প্যানিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা

প্যানিক ডিজঅর্ডার সম্পূর্ণ চিকিৎসাযোগ্য একটি রোগ। প্যানিক ডিজঅর্ডারের কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সাধারণত, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এই রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। চিকিৎসার মূল পদ্ধতিগুলো হলো-

১. সাইকোথেরাপি (Psychotherapy)

বিভিন্ন ধরনের থেরাপি প্যানিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। এর মধ্যে কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy বা CBT) সবচেয়ে কার্যকর থেরাপি। CBT-এর মাধ্যমে রোগীকে প্যানিক অ্যাটাকের কারণ ও লক্ষণগুলো বুঝতে এবং ভয় মোকাবেলা করার কৌশল শিখতে সাহায্য করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে CBT-এর মাধ্যমে ৭০-৮০% রোগী উপকার পান।

থেরাপিস্টরা রোগীকে তাদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলো আইডেন্টিফাই করতে এবং সেগুলোকে ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে শেখান। এছাড়া, এক্সপোজার থেরাপির (Exposure Therapy) মাধ্যমে রোগীকে ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতি বা অনুভূতির সাথে পরিচিত করানো হয় যা তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করে, যাতে তারা ভয়কে জয় করতে পারে।

২. ওষুধ (Medication)

কিছু ওষুধ প্যানিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করতে পারে। সাধারণত, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (Antidepressants) এবং অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি (Anti-anxiety) ওষুধ ব্যবহার করা হয়। Selective Serotonin Reuptake Inhibitors বা SSRI এবং Serotonin-Norepinephrine Reuptake Inhibitors বা SNRI নামক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলো দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে, বেনজোডায়াজেপিনস (Benzodiazepines) নামক অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধগুলো দ্রুত কাজ করে এবং প্যানিক অ্যাটাকের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে। অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করবেন।

৩. জীবনধারা পরিবর্তন

এছাড়া জীবনযাত্রায় কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন এনে এই প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। যেমনঃ নিয়মিত ব্যায়াম করা, ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা, পর্যাপ্ত ঘুমাবো কিংবা মেডিটেশন ইত্যাদি।

প্যানিক ডিজঅর্ডারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

প্যানিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু ব্যক্তি এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক দাবি করেন যে, হোমিওপ্যাথি প্যানিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। হোমিওপ্যাথিতে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যক্তিগতভাবে ওষুধ দেওয়া হয়।

তবে, এই বিষয়ে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মানসিক চিকিৎসক প্যানিক ডিজঅর্ডারের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন সাইকোথেরাপি এবং ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকে মুক্তির উপায়

প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব আর এর জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমনঃ চিকিৎসা গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম, মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ কমানো ইত্যাদি।

সারাংশ

প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি বাস্তব মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনমান গুরুতরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি শারীরিক এবং মানসিক উভয় লক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে সুখবর হলো- এটি সম্পূর্ণ চিকিৎসাযোগ্য। সাইকোথেরাপি, ওষুধ এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে অধিকাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।

যদি আপনি সন্দেহ করেন যে আপনার প্যানিক ডিজঅর্ডার আছে, আমাদের নিরাময় হাসপাতালের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

BOOK APPOINMENT