আমাদের সবার জন্য দিনের দৈর্ঘ্য কেবল ২৪ ঘন্টা। এই সীমিত সময়ে আমরা কত ধরনের চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কর্ম ও সমস্যায় জর্জড়িত হই তার যেন আর ইয়ত্তা নেই। এই সীমিত সময়ে আমরা কখনো হাসি-খুশি থাকি, কখনো দুশ্চিন্তিত থাকি, আবার কখনো চরম মানসিক অস্থিরতায় ভুগি।
সুস্থ ও সুন্দর মন সুস্থ দেহের পরিপূরক। মানসিক সুস্থতা আমাদের স্বাভাবিক আয়ু বাড়ায়। মানসিক অস্থিরতা বা উদ্বেগ এই সময়ের একটি সাধারণ সমস্যা, যা আমাদের জীবনের আনন্দ ও স্বস্তি কেড়ে নিতে পারে।
কাজের চাপ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আর্থিক সমস্যা বা ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেকেই মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। তবে কিছু সঠিক কৌশল অবলম্বন করলে এই অস্থিরতা দূর করা সম্ভব। চলুন জেনে নিই, মনের অস্থিরতা দূর করার সেরা ১০টি কৌশল, যা আমাদের মানসিক প্রশান্তি ও সুখের পথে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
কোনো প্রকার ওষুধের সাহায্য ছাড়াই কিছু দৈনন্দিন কাজকর্মের মাধ্যমে আমরা মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারি। সবসময় হাসি-খুশি ও প্রফুল্লচিত্তে থাকতে এবং মানসিক সুস্থতা ধরে রাখতে আমরা নিচের কৌশলগুলো অনুসরণ করতে পারি। এগুলো বৈজ্ঞানিকভাগে প্রমানিত।
মেডিটেশন বা যোগ ব্যায়াম মানসিক অস্থিরতা দূর করার জন্য একটা খুবই কার্যকরী কৌশল। এটি যে শুধু মনে খেয়াল রাখে তা নয়, শরীরের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতেও সহায়তা করে। তিদিন মাত্র কয়েক মিনিট মেডিটেশন করার মাধ্যমে আমাদের মনকে শান্ত ও স্থির রাখা সম্ভব। এটি আমাদের চিন্তা ও উদ্বেগ কমাতে ও কাজে ফোকাস ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ঘুম হচ্ছে এমন এক ধরনের ক্রিয়া যার উপকারিতা বলে শেষ করতে হলে এমন আরো ৫টি ব্লগ লেখার প্রয়োজন পড়বে। পর্যাপ্ত ঘুম শুধু যে আপনার মানসিক অস্থিরতা দূর করবে তা নয়, এটি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুকি কমানো, হজমশক্তি বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সহ অসংখ্য বেনিফিট দেবে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে ৭ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ঘুমানো উচিত। আমাদের অনেকের মধ্যে রাতে জেগে থেকে দিনে ঘুমানোর একটা বদঅভ্যাস আছে। এটাকে আমি বদঅভ্যাস বলছি এ কারণে যে, দিনের ঘুম আমাদের স্বাস্থের জন্য যতটা না উপকারি তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এজন্য চেষ্টা করবে রাতে কমপক্ষে ৭ ঘন্টা ঘুমাতে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার কোনগুলো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনার মাথায় নিশ্চয়ই, বার্গার, পিজ্জা, আইসক্রিম, ফ্রাইড চিকেনের মতো মজাদার খাবার নাম সবার আগে আসছে। আমরা অনেকেই জানি এরকম ফাস্টফুডগুলো আমাদের স্বাস্থের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে এই ধরনের মুখরোচক অথচ ক্ষতিকর খবার পরিহার করে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর ও বিশেষ করে সুষম খাবার খেতে হবে।
সহজলভ্য এমন কিছু অধিক পুষ্টিকর খাবার যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের বাদাম, খেজুর, শসা, ডিম, কলা, দুগ্ধজাত খাবার, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেতে পারেন। এছাড়া খাবারে নিয়মিত সবুজ শাক, বিভিন্ন ধরনের সবজি রাখতে পারেন। চেষ্টা করবেন যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেজড খাবার পরিহার করে চলতে।
একটা কথা প্রচলিত আছে যে- You are average of the 5 people you spend most with. অর্থাৎ আমরা সেই সকল মানুষদের গড় যাদের সাথে আমরা প্রায়শই মিশি। আপনি যদি নিয়মিত নেতিবাচক চিন্তা-ধারণা বহণকারী মানুষের সাথে চলাফেরা করেন তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে যে, আপনিও তাদের মতোই হবেন।
সুতরাং মানসিক অস্থিরতা বা নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা কাটিয়ে উঠতে নেতিবাচক মানুষের সহচার্য এড়িয়ে চলুন।
নেতিবাচক মানুষদের এড়িয়ে চলবেন তার মানে এই নয় যে আপনিক অসামাজিক হবে না একাকী বাস করবেন। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে আমরা কেউ একাকী জীবনযাপন করতে পারি না।
ভালো মানুষের সাথে মিশুন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখুন, সৌজন্যমূলক আচরণ করুন। এই ডিজিটাল যুগে আমরা অনেকটাই পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি, তা মানসিক স্বাস্থে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মনের অস্থিরতা দূর করতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কিছুক্ষণ শারীরিক ব্যায়াম করতে পারেন। এটি শরীরকে যেমন ভালো রাখবে তেমনি মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করবে। Push up, leg raise, high knees, jumping jack, forward lunges, squats এর মতো সহজ ব্যায়ামগুলো করতে পারেন। বিকেলে বা এ সময়ের আশেপাশে ব্যায়াম করলে রাতে ঘুম ভালো হয়।
উল্টোদিক থেকে সংখ্যা গণনা মানসিক অস্থিরতা দূর করতে ও কাজে ফোকাস ধরে রাখতে খুবই কার্যকরী একটি কৌশল। উল্টোদিক থেকে গণনা করতে আমাদের বর্তমানে অধিক মনোযোগী হতে হয়, যা দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে। এমনকি এটি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ও ঘুমাতেই সাহায্য করে।
পছন্দের কাজ যেমন বই পড়া, গান শোনা, বাগান করা বা আঁকাআঁকি করা আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। অবসর সময়ে বা মন খারাপ বোধ করলে আপনার পছন্দের কাজ করতে পারেন। এতে সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে এবং ভালোলাগার কাজের মধ্যে যুক্ত থাকতে পারবেন।
আমরা সকলেরই নিজ নিজ ধর্মের প্রতি, ধর্মের বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। ধর্মীয় কাজে মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে আমরা মানসিক অস্থিরতা দূর করতে পারি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলে মন শীতল হয়। আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেন, নিজ ধর্মীয় প্রার্থনা মাধ্যমে মানসিক স্থিরতা অনুভব করতে পারেন।
মানসিক চাপ মোকাবেলা করে প্রফুল্লচিত্তে থাকার অন্যতম উপায় হতে পারে ভ্রমণ। ভ্রমণ যে শুধু আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা তা নয়, মানসিক অস্থিরতা দূর করতেও অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের নতুন মানুষের সাথে, নতুন সংস্কৃতি ও পরিবেশের সাথে পরিচয় ঘটে, যা ভিন্ন আমাদের ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবতে ও চিন্তা করতে সহযোগিতা করে।
দীর্ঘদিন মানসিক অস্থিরতায় থাকলে সেটি আপনার কোনো গুরুতর মানসিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শারীরিক কিংবা মানসিক শান্তি দানের একমাত্র ক্ষমতা কেবল মহান আল্লাহ তায়ালার। আমাদের নবী রসুলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ মানসিক অশান্তি কিংবা পেরেশানি থেকে মুক্তি পেতে কিছু দোয়া পড়তেন ও আমল করতেন।
মনের দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার এমন একটি দোয়া হলো-
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়া রাব্বুল আরদি ওয়া রাব্বুল আ’রশিল কারিম।
অনুবাদঃ আল্লাহ্ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি অতি মহান, অতি সহনশীল। আল্লাহ ব্যতিত কোনো সত্য ইলাহ বা উপাস্য নেই, তিনি বিশাল আরশের মালিক। আল্লাহ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি আসমান-জমিনের এবং মহান আরশের অধিপতি।
সুখ-দুঃখ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও আমরা কেবল সুখকেই পেতে চাই। পৃথিবীর সমস্ত কাজের উপরে আমাদের যেহেতু নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু মানসিক অস্থিরতা, পেরেশানি, দুশ্চিন্তা জীবন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারি না। কিন্তু কিছু কার্যকরী কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে মানসিক অস্থিরতা দূর করতে পারি।
আশা করছি, আজকের ব্লগে উল্লিখিত মনের অস্থিরতা দূর করার সেরা ১০টি কৌশল আপনার কাজে আসবে।