বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার তথ্যমতে, পৃথিবীজুড়ে প্রতি ৮ জনের ১ জন মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগে। শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক হলেও আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে একেবারেই গুরুত্ব দেই না। আমরা সামান্য শারিরীক অসুস্থতা অনুভব করলেই দ্রুত ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু মানসিক সাস্থ্যের ব্যাপারে ঠিক ততটাই অনাগ্রহী।
শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য দুইটা বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। আজকের ব্লগে আমরা জানবো মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ১০টি উপায় সম্পর্কে। এসব উপায় বা অভ্যাস বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত।
আজ আমরা এমন ১০টি অভ্যাস নিয়ে আলোচনা করবো যেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য থাকবে আরো ভালো এবং সারাদিনের কাজকর্মে অনেক বেশি মোটিভেটেড ও এনার্জেটিক অনুভব করবেন।
এই উপায়গুলো প্রতিপালনের মাধ্যমে যে আপনি শুধু দৈনন্দিন কাজকর্মে উৎফুল্লতা পাবেন তা নয়, দির্ঘমেয়াদী জীবনযাপনেও আসবে সুস্থতা।
১. শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন
শরীর ও মন উভয় সুস্থ রাখতে পারে আপনার প্রতিদিনের পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম। নিয়মিতভাবে সকালে অথবা বিকেলে হালকা ওয়ার্ক-আউট, হাটাহাটি বা জগিং, সাইক্লিং করলে তা শরীরকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করে এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
বিকেলে বা সন্ধ্যায় হালকা ওয়ার্ক-আউট করলে তা রাতে ঘুমানোর জন্য খুবই উপকারী। আর পর্যাপ্ত ও সুস্থ ঘুম সুস্থ শরীর ও সুস্থ মনের পূর্বশর্ত। সুতরাং নিয়মিত হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
২. সামাজিকভাবে সংযোগ করুন
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আমরা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যায় ভুগছি তা হলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের মতো প্ল্যাটফর্মে আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বললেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো আমাদেরকে অসামাজিক করে তুলছে।
আমরা তরুণরা বেশি সমস্যায় ভুগছি। সারাদিন মোবাইল ফোনে বুদ হয়ে থাকে, চার দেয়ালের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করা, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাথে মেশা ধীরে ধীরে অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সামাজিক সংযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা থাকলেও কিছুটা সময় বের করে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাথে সময় কাটান, আড্ডা দিন, হাসিখুশিতে মেতে উঠুন। হাসি মানসিক রোগ দূর করতে পারে।
৩. ধ্যান করুন
যোগব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম। নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যান করলে তা মনকে শান্ত রাখে এবং মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। আমাদের অনেকেরই মেডিটেশন সম্পর্কে ধারণা কম। এটি শেখার জন্য ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিয়ো রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করতে পারেন। Meditation বা ধ্যানের আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ আসক্তি নিয়ন্ত্রণে, কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে, ঘুমাতে, দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।
৪. আপনার অনুভূতি শেয়ার করুন
চাপা কষ্ট বা সমস্যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আপনি কোনো মানসিক সমসার মধ্যে থাকলে না কেবল নিজের মধ্যে চেপে রাখবেন না। পরিবার, কাছের মানুষ, বন্ধু-বান্ধবের সাথে শেয়ার করুন। নিজের সমস্যা অন্যদের সাথে শেয়ার করলে তা আপনাকে অনেকটা প্রশান্তি দেবে।
কিন্তু চাপা কষ্ট নিজের মধ্যেই পুষে রাখলে সে সমস্যা আরো ভয়ঙ্কর হতে পারে।
৫. স্বাস্থ্যকর খাবার খান
কোনো মেশিন চালাতে যেমন শক্তি প্রয়োজন, তেমনি আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন করতেও শরীরের শক্তি প্রয়োজন হয়। আর আমাদের শক্তির মূল উৎস হচ্ছে খাবার। তবে আমাদের প্রতিদিনের গ্রহণ করা খাবার স্বাস্থ্যকর কিনা সে বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ সুষম খাবার খেতে হবে। যারা অনেক বেশি কায়িক পরিশ্রম করে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার এবং যারা মানসিক পরিশ্রম করে তাদের জন্য আয়রন ও ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
৬. শখের কাজ করুন
পছন্দ বা শখের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য খুবই নিবিড়ভাবে জড়িত। শখের কাজ করলে আমাদের মন ভালো থাকে। সেজন্য অবসরে আপনার পছন্দের কাজকর্ম করতে পারেন। কেউ খেলতে পছন্দ করেন, কারো কারো আবার বাগান করা, ফটোগ্রাফি করা, সাইক্লিং করা পছন্দ।
অনেকে আবার ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করেন। সীমিত পরিমাণ সময় ধরে ভিডিও গেম খেললে তা গ্রহণযোগ্য। তবে দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার বা মোবাইলে ভিডিও গেম খেললে এতে আমাদের চোখের ক্ষতি হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
৭. নিজের জন্য সময় বের করুন
আমরা অনেকেই পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে নানান দুশ্চিন্তায় থাকি। এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে নিজের সাথে নিজেই আলোচনা করে। এজন্য প্রয়োজন নিজের জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করা। কর্মব্যস্ততার মাঝে নিজের জন্য সময় বের করুন। এ সময়ে নিজেই নিজের সাথে কথা বলুন, বোঝাপড়া করুন।
৮. পর্যাপ্ত ঘুম
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আরেকটু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আমাদের চোখের সমস্যা, সারাদিন ক্লান্ত অনুভব করা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, চোখের নিচে দাগ পড়া, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি সহ নানান সমস্যা হতে পারে।
রাতে শিশুদের জন্য ৮ ঘন্টা এবং প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য ৬-৭ ঘন্টা ঘুমানো খুবই জরুরি। দিনে ঘুমানোর চেয়ে রাতে ঘুমানো অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
৯. মোবাইল ফোনের ব্যবহার কমান
বর্তমান সময়ে প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো ও মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে মোবাইল ফোন। আমরা ছোট-বড় সবাই এই ডিভাইসে আসক্ত। মোবাইল ফোনের ব্যবহার কমিয়ে এনে শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলায় সময় ব্যয় করলে তা শরীর ও মন উভয়ের জন্যই উপকারী।
মোবাইলের ব্যবহার কমাতে ও কাজে ফোকাস ধরে রাখতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া অ্যান্ড্রোয়েট ফোনে Digital Wellbeing ফিচারটাও অনেক কাজের।
১০. প্রয়োজনে সহযোগিতা নিন
মানসিক সমস্যা কোনো লজ্জার বিষয় নয়। আপনি যদি অতিমাত্রায় মানসিক কোনো সমস্যায় ভুগেন এবং তা আপনার জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আমাদের নিরাময় হাসপাতালে একাধিক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের থেকে সেবা নিয়ে অনেক রোগী এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। আপনিও চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
শারীরিক সুস্থতা যতটা জরুরি, মানসিক সুস্থতাও ঠিক ততটাই জরুরি। তাই মানসিক কোনো সমস্যাকে অবহেলা করা উচিত নয়। এই ধরনের সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে অতিদ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আশা করছি, আজকের ব্লগে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় সম্পর্কে জানাতে পেরেছি।