কখনো না কখনো হিস্টিরিয়া রোগ সম্পর্কে শুনেছেন বা কাউকে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখেছেন। আর আপনি যদি হিস্টিরিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে আজকের লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
এখানে হিস্টিরিয়া রোগের কারণ, লক্ষ্মণ ও চিকিৎসা বা প্রতিকার সম্পর্কে জানাবো। আসুন প্রথমেই জেনে নিই হিস্টিরিয়া রোগটি আসলে কী এবং এর সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য।
হিস্টিরিয়া হলো একধরনের মানসিক রোগ যেখানে ব্যক্তি তার মনঃকষ্ট বা আবেগ অবচেতন মনে শারীরিক উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ করে। মানসিক রোগ মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো মৃদুমাত্রায় যাকে বলা হয় নিউরেসিস এবং অপরটি হলো অতিমাত্রায় যাকে বলা হয় সাইকোসিস।
অনেকেই এটাকে পাগলামি বা জিনের আছড় বলে বর্ণনা করলেও এটি হলো মূলত একটি নিউরেসিস জাতীয় মানসিক রোগ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো কনভার্সন ডিসঅর্ডার।
সাধারণত নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই রোগটি হতে পারে। তবে স্বল্পবয়সী নারী, যেমন ১৪ থেকে ২০/২২ বছরের নারীদের মধ্যে এই রোগটি বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি হওয়ার কারণটা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন হরমোন জনিত কারণে এটা মেয়েদের বেশি হয়।
শুরুর দিকে এটিকে জরায়ুর রোগ হিসেবে চিহ্নির করা হলেও ১৮১৫ সালের দিকে অস্ট্রিয় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, সিগমুন্ড ফ্রয়েড এটাকে মস্কিষ্কের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মানুষের সহজাত আচরন অন্যদের কাছে প্রকাশিত হতে গেলে রোগীর মস্তিষ্ক তাতে বাধা দেয় এবং তাকে ভীত ও দুশ্চিন্তিত করে তোলে। এভাবে বেশি সময় ধরে মানুষের মানসিক আচরনকে প্রকাশিত হওয়া থেকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।
যার ফলে ব্যক্তি তার অবচেতন মনেই এই আচরনগুলো অস্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করে ফেলে। আর এই অবস্থাকেই আমরা হিস্টিরিয়া রোগ বলে অখ্যায়িত করছি।
চলুন এবার জেনে নিই আসলে কী কারণে এই রোগটি হতে পারে।
এই রোগের বেশ কিছু কারণ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণের পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি কারণ আছে হিস্টিরিয়া রোগের পেছনে। সেগুলো হলোঃ
ব্যক্তি যদি অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকে বা দুশ্চিন্তা করে তাহলে এই সমস্যাটি তার মধ্যে প্রতীয়মান হতে পারে। এটা বেশিরভাগ সময় নারীদের মধ্যে দেখা যায়। তারা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে অনেক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়, তখন হিস্টিরিয়া হতে পারে।
হিস্টিরিয়া রোগের অন্যতম কারণ হলো শারীরিক অলসতা। অর্থাৎ যারা দীর্ঘ সময় ধরে কাজের প্রতি অনীহা দেখায় এবং সারাক্ষণ অলস সময় পার করে তাদের মধ্যে এই রোগটি দেখা যেতে পারে।
বেশিরভাগ সময় ভয় বা নানারকম ফোবিয়া জনিত কারণে হিস্টিরিয়া হতে পারে। এটা হয় বেশিরভাগ সময় নারীদের ক্ষেত্রে এবং এই কারণে সবচেয়ে বেশি এই রোগটি হয়ে থাকে।
নারীরা অন্ধকার, একাকী চলাফেরা বা অন্যান্য কারণে ভয় পেলে তার ফলসরূপ এই মানসিক রোগটি হয়, যেটাকে আমরা অনেকেই পাগলামি বা জিনের আছড় বলে ব্যাখ্যা করতে চাই।
পরিবারে মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা বংশের কেউ আগে থেকে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেটার জন্য অনেকটা দায়ী জিনগত সমস্যা।
কোনো ব্যক্তি শারীরিক বা মানসিকভাবে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে তার পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হিস্টিরিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
মানব মস্তিষ্কের দুইটি অংশ থাকে। একটি হলো ডান পাশ যেটাকে বলা হয় Intuitive Side এবং অপরটি হলো বাম পাশ যাকে বলা হয় Rational Side। মানব মস্তিষ্কের এই দুই অংশের ক্রিয়ার মধ্যে অসন্বয় ঘটলে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
ভয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা, মানসিক আঘাত, অনিয়মতান্ত্রিক জীবন-যাপন, মানসিক অবসাদ, ট্রুমাটিজম, ঘনিষ্ট কারোর মৃত্যুশোক, দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতা অথবা প্রেমে প্রত্যাখ্যানের কারণে হিস্টিরিয়া রোগ দেখা দিতে পারে।
মানুষের মন যখন পরিবেশগত দ্বন্দ্ব বা চাপের মুখোমুখি হয় তখন এই রোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। যেমনঃ কাউকে অকারণে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করা, শারীরিক, মানসিক বা যৌন নিপীড়িন করা ইত্যাদি কারণে হিস্টিরিয়া রোগ হতে পারে।
এছাড়াও স্ট্রেস, ট্রুমাটিজম, হস্তমৈথুন, ব্রেইন টিউমার ইত্যাদি কারণেও হিস্টিরিয়া রোগ হতে পারে। আসলেই এই রোগের নির্দিষ্ট সংখ্যক কোনো কারণ উল্লেখ করেননি বিশেষজ্ঞরা।
হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মূলত নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে অবচেতন মনে নানারকম কাজকর্ম করে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারে। এর লক্ষণগুলো খুবই নাটকীয়ভাবে প্রকাশ পায়, যা অন্যান্য মানসিক রোগ থেকে একে করেছে ভিন্ন।
হিস্টিরিয়ার বেশ কিছু অতি সাধারণ লক্ষণ আছে, এগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো শারীরিক প্রকাশকে বলা হয় প্রথমিক অর্জন বা Primary Gains এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন কাজকর্ম থেকে মুক্তির সুবিধা খোঁজাকে বলা হয় হিস্টেরিক অর্জন বা Hysteric Gain।
তবে হিস্টিরিয়া রোগের বেশকিছু অতি পরিচিত লক্ষণসমূহ হলোঃ
উপরে উল্লিখিত উপসর্গগুলো ছাড়াও আরো অনেক উপসর্গ থাকতে পারে। তবে খুবই স্বাভাবিক যে লক্ষণগুলো হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় সেগুলো জানাতে চেষ্টা করলাম।
এটা আহামরি কোনো মানসিক রোগ নয়। অন্যান্য মানসিক রোগগুলোর মতো এরও সঠিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তাই আপনার নিজে বা কাছের কোনো মানুষ যদি এই মানসিক সমস্যায় ভোগেন তাহলে একদমই বিচলিত না হয়ে সঠিকভাবে নিয়মকানুন মেনে এর চিকিৎসা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা জরুরি।
প্রথমে রোগীকে দুশ্চিন্তানাশক ঔষধ দেবন করানো হয়। এর ফলে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অনেকখানি উন্নতি হয়। এরপরেও কিছু সমস্যা থেকে গেলে সেগুলোর প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যাকে বলা হচ্ছে “অ্যাবরিয়্যাকশন মেথড”।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় সকলেই প্রথম চিকিৎসায় কয়েক মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। বাকিরা পরবর্তী আরো কিছু নিরাময় পদ্ধতির মাধ্যমে সুস্থ হয়। আশার কথা হলো এই যে, এই রোগে আক্রান্ত শতভাগ মানুষই একেবারে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
কয়েকটি উপায় অনুসরণ করে হিস্টিরিয়া রোগের নিরাময় অথবা চিকিৎসা করা সম্ভব। সেগুলো হলোঃ
হিস্টিরিয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশিত হলে মোটেও বিচলিত বা উৎকণ্ঠিত হবার কারণ নেই। প্রথমেই একজন ভালো নিউরেসিস্ট চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে। তাকে আপনার সমস্যাগুলো ঠিকঠাকভাবে জানাতে হবে। তাহলে তিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে পারবেন।
ঘরোয়া পদ্ধতি অথবা ফিজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। অনেকেই প্রথমবার ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতির পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তবে এই উপায়ে ফলাফল শূণ্য হলে থেরাপি অথবা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হবার পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও বিভিন্ন থেরাপি ছাড়াও ঘরোয়া কিছু সাবধানতা বা প্রতিকারের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সেগুলো হলোঃ
উপরে উল্লিখিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে সহযোগীতা করতে হবে। রোগীর প্রতি ক্রদ্ধ বা বিরক্ত না হয়ে সহানুভূতিশীল আচরন করা খুবই প্রয়োজন। তাহলে আশা করা যায় হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।