অনেকসময় শৈশবকালেই বহু শিশুর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে ভীষণ বিচলিত এবং ভীত হয়ে পড়েন। তবে এক্ষেত্রে ভয় না পেয়ে, বাচ্চার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। কেননা মানসিক সমস্যা অনেক সময় শারীরিক সমস্যার চেয়েও বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আর এতে যদি সঠিক চিকিৎসা করা হয়, তবে বাচ্চারা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আসুন আজকের আর্টিকেলে শিশুদের মানসিক রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
অনেক সময় শিশুরা অনেক বেশি দুষ্ট আর চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এতে তারা অনেক ক্ষেত্রে খারাপ আচরণ করে থাকে। আর এই বিরূপ আচার-আচরণ মানেই মানসিক সমস্যা নয়।
সাধারণত অভিভাবকদের পজেটিভ প্যারেন্টিং এই ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করে। সেক্ষেত্রে আপনার সন্তানের দিকে অধিক মনোযোগ দিন এবং সে কেন এই ধরনের আচরণ করছে সেটা বুঝে, তা সমাধানের চেষ্টা করুন।
তবে আপনার বাচ্চা যদি অতিরিক্ত জেদী, একগুঁয়ে ও অবাধ্য আচরণ করে এবং তা আপনি সামলাতে না পারেন, এক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে যে, ‘এখানে ১৮ শতাংশের বেশি শিশু, কিশোর-কিশোরী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত।’
সাধারণত অনেক কারণে বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে জেনেটিক, বিরূপ পরিবেশগত, টক্সিক প্যারেন্টিং, কোন শারীরিক রোগ, বড় কোন দুর্ঘটনা ইত্যাদির কারণে শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তাইতো, আপনার সন্তানের মধ্যে যদি কোন অস্বাভাবিক আচার-আচরণ দেখেন, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
বেশিরভাগ ছোট্ট বাচ্চারাই অনেক বেশি চঞ্চল হয় এবং বিভিন্ন ধরনের আচার-ব্যবহার করে থাকে। সেক্ষেত্রে সবসময় যে কোন সমস্যা বা অসুস্থতার কারণে এমনটা করে তা কিন্তু নয়। তবে আপনার সন্তান যদি দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে, তাহলে তা কিছুটা দুশ্চিন্তার কারণ বটে।
এই প্রসঙ্গে মানসিক বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার মনে করেন যে, ‘অনেক সময় শিশুদের আচরণে সমস্যা তৈরি হয়। তখন সে খুব রেগে যায়, ভাঙচুর করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।
এছাড়াও সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারে না, পড়ালেখায় আগ্রহ থাকে না, ঠিকমতো ঘুম ও খাওয়াদাওয়া করে না।’ তাইতো, এসব লক্ষণ দেখা গেলে বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আসুন শিশুদের মানসিক রোগের আরও কিছু লক্ষণ জেনে নিই-
● শিশু সমবয়সী বাচ্চাদের থেকে ভিন্ন এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।
● সবকিছুতে অতিরিক্ত চঞ্চলতা, রাগ, জেদ এবং অবাধ্য আচরণ করে।
● অনেকসময় অতিরিক্ত রেগে গিয়ে নিজেকে কিংবা অন্যকে আঘাত করে বসে।
● বাচ্চা সারাক্ষণ বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগে।
● অন্যের প্রতি প্রতিশোধমূলক এবং উগ্র আচরণ করে থাকে।
● শিশু ঘন ঘন মাথা ঝাঁকায়।
● সারাক্ষণ অন্যমনস্ক অবস্থায় এবং দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে।
● অস্থিরতা, ভুলে যাওয়া এবং উদ্ভ্রান্তের মতো ছটফট আচরণ করে।
● কোন কিছু নিয়ে অস্থিরতা দেখায় এবং একটানা অতিরিক্ত কান্না করে।
● অগ্রহণযোগ্য, দৃষ্টিকটু এবং নেতিবাচক আচরণ করে থাকে।
● বাচ্চা রুটিন অনুযায়ী কাজ করতে পছন্দ করে না।
● অনেকবেশি আবেগপ্রবণ হয় এবং নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
● শিশু অনেক দেরিতে কথা বলা শেখে এবং বিভিন্ন কাজকর্মে অপটু হয়ে থাকে।
● অতিরিক্ত দুষ্টামি এবং বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
● এই ক্ষেত্রে বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা কম হয় এবং অ্যাবনরমাল আচরণ করে।
● অনেক ক্ষেত্রে ডাকলে সাড়া দেয় না বরং আত্মমগ্ন অবস্থায় থাকে।
● অনেকসময় বাইরের কাউকে কিংবা অন্য কোন মানুষের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না।
সাধারণত অল্পবয়সী বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- অটিজম, ডিসলেক্সিয়া, শর্ট টার্ম মেমোরি লস, ক্লেপটোম্যানিয়া, এডিএইচডি, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, অপজিশনাল ডেফিয়েন ডিজঅর্ডার (ওডিডি) ইত্যাদি।
অটিজম বা অটিস্টিক একটি মনোবিকাশগত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। এটি একটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক সমস্যা। মূলত এই সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলা হয়।
এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে তারা কথা বলতে অথবা কিছু বুঝতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং স্বাভাবিক ভাবে চলতে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এছাড়াও এতে আক্রান্তদের মধ্যে সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বধিরতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে।
সাধারণত ডিসলেক্সিয়া এক ধরনের লার্নিং ডিসেবিলিটি। এতে বাচ্চাদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। কেননা এতে আক্রান্ত শিশুদের পর্যাপ্ত বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্ত্বেও তারা সেভাবে পড়া মনে রাখতে পারে না।
এই রোগে আক্রান্ত হলে তারা বিশেষ কিছু অক্ষর, শব্দ ইত্যাদি মনে রাখতে বেশ সমস্যায় পড়ে যায়। আবার অনেক সময় ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাদের মধ্যে স্মৃতিভ্রমও দেখা দিতে পারে।
মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতাকে বলে শর্ট টার্ম মেমোরি লস বা স্মৃতিভ্রম। অনেকসময় শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্রেইন টিউমার, মাথায় আঘাত পাওয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি কারণেও এই ভুলে যাওয়া সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সাধারণত ক্লেপটোম্যানিয়া মানুষকে চুরি করতে তাড়না করে। অনেক সময় শিশু- কিশোররা এই মানসিক রোগে ভুগতে পারে। মূলত এতে আক্রান্তরা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই চুরি করে থাকে। এতে রোগী চুরি করতে না পারা পর্যন্ত, অনেক অস্বস্তিতে ভোগেন। ফলে চুরি করতে পারলে আত্মতুষ্টি পান।
গবেষকদের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য হওয়ার কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
এই এডিএইচডি বাচ্চাদের এক ধরণের আচরণগত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। এতে আক্রান্ত শিশুরা অনেক ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকে। আর তারা কোন কাজই পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের মাঝে ভীষণ অস্থিরতা এবং কাজকর্ম অসম্পূর্ণ করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়াও এই সমস্যার ফলে শিশুদের মধ্যে সাময়িক স্মৃতিভ্রম বা শর্ট টার্ম মেমোরি লস দেখা দিতে পারে।
কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরীর মাঝে অতিরিক্ত আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বাচ্চার দুরন্ত স্বভাব অথবা অবাধ্যতাকে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে ধরা হয়। মূলত এটি কৈশোরের একটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত।
শিশুদের মধ্যে ব্যাঘাতমূলক আচরণগত ব্যাধি হল অপজিশনাল ডেফিয়েন ডিজঅর্ডার। এটি আচার আচরণ এবং আবেগের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সমস্যা তৈরি করে। এতে বাচ্চারা আক্রমণাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব প্রদর্শন করে। আর যার ফলে তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আপনার সন্তানের মধ্যে এই সব মানসিক রোগ দেখা দিলে ঘাবড়ে যাবেন না। কেননা বর্তমানে শিশুদের মানসিক সমস্যার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে নিরাময় হাসপাতালের আধুনিক এবং কার্যকরী চিকিৎসার মাধ্যমে আপনার বাচ্চা সুস্থ স্বাভাবিক এবং সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবে।
এখানে সাইকিয়াট্রিক ডাক্তার কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা আপনার সন্তানের রোগ নির্ণয় করে যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। আর তাইতো আপনার ছোট্ট সোনামণির মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ দেখলে, দেরি না করে নিরাময় হসপিটালের মানসিক বিভাগে যোগাযোগ করতে পারেন।
মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মানসিক রোগ মানেই পাগল বা খারাপ কিছু নয়। যেকোনো বয়সেই যে কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সেক্ষেত্রে আপনার সন্তানের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিলে, বিচলিত না হয়ে এবং কুসংস্কারের ফাঁদে না পড়ে, বরং তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।