“মনের অসুখের জন্য ওষুধের প্রয়োজন হয় না, কেবল কাউন্সেলিং করলেই হয়।” “সাইকোথেরাপি! না না সঠিক নিয়মে ঔষুধ গ্রহণ করলেই হবে।” – এমনই বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন মতামত শুনে আপনি চিন্তিত? আপনি কি সঠিক পথেই এগোচ্ছেন কি-না সে বিষয়ে সংশয়ে রয়েছেন? নিশ্চিন্তে থাকুন, কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নিয়ে যত ধারণা ও বিভ্রান্তির সকল উত্তর মিলবে এই আর্টিকেলটিতে।
শুরুটা একটা ঘটনা দিয়ে করা যাক,
বেশ কিছুদিন ধরে অর্নব মাথা ব্যাথার সমস্যায় ভুগছে। খাবারের প্রতি দেখা দিচ্ছে অনীহা। ডাক্টারের কাছে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরেও শারীরিক কোনো সমস্যার দেখা পায়নি।
অতঃপর ডাক্টার বললেন তার শারীরিক সমস্যার কারণ শারীরিক রোগ নয় বরং মনবৈজ্ঞানিক কারণ দায়ী। তাই তাকে পরামর্শ দেয়া হলো কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নামক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে চিকিৎসা করানোর জন্য।
ঘটনাটি থেকে একটা নতুন ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতির ধারণা উঠে আসে আর সেটি হলো কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, “কি এই কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি?” আসুন জেনে নেয়া যাক।
কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির মধ্যে কিছু পার্থক্য দৃশ্যমান যা পরবর্তী ধাপে জানানো হবে। তবে আপাতত উভয় শব্দকে একই অর্থে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এখানে যারা প্রোফেশনালি চিকিৎসা সেবা প্রদান করে তাদের সাইকোথেরাপিস্ট বা কাউন্সেলর বলে। অন্যদিকে যাদের পেশাগত চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের ক্লায়েন্ট বলে। উল্লেখ্য যে, এটা কোনো রোগ নয় তাই ক্লায়েন্টকে কখনই রোগী বলা যাবে না।
মূলত কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি হলো এমন এক ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে সাইকোথেরাপিস্ট বা কাউন্সেলর এর সাথে ক্লায়েন্ট নিজের প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় খোলামেলাভাবে আলোচনা করে। পাশাপাশি ক্লায়েন্টের পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফ্রেন্ড সার্কেল, কর্মস্থানসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, গবেষণামূলক তথ্য ও পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যা বিশ্লেষণ করেন এবং কিভাবে সে সমস্যা থেকে বেড়িয়ে আসা যায় সেটির চিকিৎসা প্রদান করে।
কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির কৌশলটিও খুব ইন্টারেস্টিং। এখানে একজন কাউন্সেলর সবসময় বিভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকেন তবে কখনই নির্দেশনা প্রদান করে না। এর কারণ হলো এতে করে ক্লায়েন্ট নিজের উপর চাপ অনুভব করেন না এবং নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যার ফলে দ্রুত তার সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সাধারণত প্রায় সবস্থানেই সপ্তাহে একদিন এক ঘন্টার জন্য সাইকোথেরাপি দেয়া হয়ে থাকে।
বৈশিষ্ট্য | সাইকোথেরাপি | কাউন্সেলিং |
উদ্দেশ্য | মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা করা | ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়ন ঘটানো |
লক্ষ্য | সমস্যার কারণ ও প্রভাব বোঝা এবং সমাধান করা | ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জন করা, সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা ও সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো |
সময় | সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী (মাস বা বছর পর্যন্ত হতে পারে) | সাধারণত স্বল্পমেয়াদী (কিছু সেশনের জন্য) |
পদ্ধতি | বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানগত পদ্ধতির ব্যবহার | বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতির ব্যবহার |
যোগ্যতা | ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত কাউন্সেলর | লাইসেন্সপ্রাপ্ত কাউন্সেলর, ট্রেইন্ড কাউন্সেলর, মেন্টর |
বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগের ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপির প্রয়োজন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো:
ইত্যাদি সহ ক্ষেত্র বিশেষে আরো অনেক কারণেই সাইকোথেরাপি নেয়ার প্রয়োনীয়তা দেখা দেয়। তবে আপনাকে জানতে হবে কখন থেরাপির জন্য একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে? পরের ধাপেই থাকছে বিস্তারিত।
যখন আপনার মধ্যে মানসিক সমস্যা গুলোর প্রভাব অনেক তীব্রভাবে অনুভব হবে তখন আপনার একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিৎ। তবে সচেতন লোকেরা উক্ত সমস্যাগুলো দেখা দেয়ার শুরুর দিকেই সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হয়। তাছাড়া যদি Specific ভাবে বলতে হয় তবে নিম্ম লিখিত কারণের জন্য সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।
আমাদের জীবনে বিভিন্ন সময় অনেক ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে কারো যদি সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয় তবে কাউন্সেলরের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে। একজন সাইকোলজিস্ট মূলত তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কিভাবে করতে হয় সেই বিষয় শিখতে সাহায্য করবে।
অতিরিক্ত আবেগ মানুষের দৈনন্দিন কাজে বাধা সৃষ্টি করে। আবেগে বশীভূত হয়ে অনেকেই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে থাকে, কেউ আবার মন খারাপের পাহাড় গড়ে। মূলত যে কাজ গুলো মানুষের আবেগে সরাসরি প্রভাব ফেলে সেসকল কাজের ফলে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার পরিমাণ যদি বেশি হয়ে যায় তবে অবশ্যই একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।
রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগগত স্বভাব হলেও কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটা মাত্রাতিরিক্ত থাকার ফলে তাদের সাথে অন্যদের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এটা যে কেবল অন্যদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে তা কিন্তু নয়, এর সাথে জরিত রয়েছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা। অনেকেই আবার রাগের তীব্রতায় নিজেরই ক্ষতি করে ফেলে। তাই এমন পরিস্থিতিতেও একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা (যেমন: মাথা ব্যাথা, ঘুম কম হওয়া, দুর্বলতা ইত্যাদি) হওয়ার পেছনের কারণও মানসিক অশান্তি। মানুষ যখন মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করে তখন তার ব্রেইন স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা থেকে অতিরিক্ত পেশার গ্রহণ করে বিধায় মাইগ্রেনের সমস্যা হয়ে থাকে। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায় যে, শারীরিক কোনো সমস্যা না থাকার সত্ত্বেও অনেকে মনে করে তাদের ভয়ংকর কোনো রোগে ভুগছে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না, এমন পরিস্থিতিতে সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়াই উত্তম সমাধান।
ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলো এমন সব অসুখ যা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। যেমন – হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। এসময় মানুষ নিজেদের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করে। সাইকোথেরাপি ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সম্পর্কিত এসব মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় সহায়ক হয়, যার ফলে এই ধরণের রোগীরা নিজেদের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারে।
আমাদের সমাজে জোর করে বাবা মায়ের পছন্দের পেশা সন্তানের মধ্যে চাপিয়ে দেয়ার প্রবনতা আছে যা পরবর্তীতে গিয়ে ভয়ংকর মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ছেলে-মেয়েরা যদি নিজেদের আগ্রহকে মূল্যায়ন করে পেশা নির্ধারণ করে তবে সফলতার সম্ভাবনাও কয়েক গুন বেড়ে যায়। সাইকোলজিস্টরা বিভিন্ন ধরণের টেস্টের মানুষের মানসিকভাবে পেশা গ্রহণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।
জীবনের কোনো পর্যায়ে এসে যদি কেউ ভয়ংকর কোনো মানসিক আঘাত কিংবা দুর্ঘটনার স্বীকার হয় তবে বার বার সেসব বিষয় মনে আসে যা সহজে এড়িয়ে চলা যায় না, আর যতবার মনে পড়ে ততবারই মানসিক পীড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই ধরণের সমস্যার সমাধান রয়েছে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে।
সঠিক যৌন শিক্ষা না থাকার কারণে অনেক সময় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই বিষয়ক বিভিন্ন ধরণের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে যৌন সমস্যা ও অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে শারীরিক দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা সৃষ্টি হয় মানসিক কারণে। এবং এ থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে একজন সাইকোলজিস্ট।
তাছাড়াও,
১) দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্ক সমস্যার সমাধানে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি গ্রহণ।
২) বিয়োগান্তক ঘটনা (যেমন – প্রিয় মানুষের মৃত্যু, যে ঘটনা থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না) থেকে বেড়িয়ে আসার ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি প্রয়োজন।
৩) আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসলে দ্রুত কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি এর প্রয়োজন রয়েছে। কোনো ভাবে এরূপ অবস্থাকে হেলা করা কিংবা কম গুরুত্বসহকারে দেখা উচিৎ না।
৪) কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি এর মাধ্যমে একজন মাদকে আসক্ত ব্যক্তিকে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব।
৫) এবং অন্যান্য মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নিলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, এবং রোগ মুক্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
মূলত উপরে উল্লেখিত ঘটনার মধ্যে কোনোটি ঘটে থাকলে অবশ্যই একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
ঢাকায় অবস্থিত নিরাময় হাসপাতাল একটি মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। যেখানে মাদকাসক্তির চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থের বিষয়েও চিকিৎসা প্রদান করা হয়। কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি এর বিষয়ে তাদের রয়েছে অভিজ্ঞ পেশাদারদের একটি দল, যেখানে রয়েছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং কাউন্সেলর।
১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আধুনিক ও মানসম্মত পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও কৌশল ব্যবহার করে কায়েন্টদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা হয়। তাছাড়া এখানে সকল কাউন্সেলরগণ প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ। তাদের উল্লেখ্যযোগ্য সেবা গুলো হলো:
তারা প্রথমে আপনার সকল বিষয় ভালোভাবে Analysis করে আপনার সমস্যা চিহ্নিত করবে এবং সেটা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মেডিসিনের পাশাপাশি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি এর মাধ্যমে আপনার সমস্যা সারিয়ে তোলার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করবে।
অতএব, এই ছিলো কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি কী এবং কখন প্রয়োজন সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমূহ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৮.৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১২.৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। [তথ্যসূত্র: কালেরকন্ঠ]
তাই কোনো ভাবে এই বিষয়টিকে হাল্কা ভাবে না নিয়ে প্রয়োজনে অবশ্যই সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নেয়া উচিৎ।