|

পর্নোগ্রাফি আসক্তি

পর্নোগ্রাফিঃ আসক্তি, লক্ষণ ও চিকিৎসা

বর্তমানে ছোট থেকে বড় সব বয়সের ছেলে মেয়েদের মাঝে পর্নোগ্রাফি শব্দটি বেশ পরিচিত। এই পর্নোগ্রাফি সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

বিশেষত, তরুণ সমাজ পর্নোগ্রাফি নামক এই ব্যাধিতে ভুগছে এবং তাদের পর্নো দেখার যে আসক্তি তা তাদের শারীরিক-মানসিক বিভিন্ন রোগে, ক্ষয়ে ভুগাচ্ছে।

যার ফলে তরুণ সমাজ ধংস্বের পথে এগোচ্ছে। এছাড়াও, তরুণ বয়সী বাদেও ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধলোকও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে।

আজ আপনাদেরকে এই পর্নোগ্রাফি আসক্তি ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানাবো যাতে যারা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তারা সহজেই এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং সুন্দর, গোছানো জীবনযাপন করতে পারে।

পর্নোগ্রাফি আসক্তি কি?

যৌন উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনসংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি বা ঘটনা ক্রমান্বয়ে বিবরণ দেওয়াই হলো পর্নোগ্রাফি।

আরো সহজভাবে বলতে গেলে- অভিনয়ের মাধ্যমে যৌনচারণ ও যৌনসঙ্গম খোলামেলা প্রদর্শন করা অথবা উগ্র ছবি, ভিডিওই হলো পর্নোগ্রাফি।

আর এই পর্নোগ্রাফি দেখার যে তীব্র বাসনা, অভ্যাস সেটাই হলো পর্নোগ্রাফি আসক্তি।

পর্নোগ্রাফি আসক্তি সম্পূর্ণ মাদকের মতো যা একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে এবং মাদকের ন্যায় শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নানাধরণের ক্ষতি করে।

অনেকের এই আসক্তি এত তীব্র যে কাজের ফাঁকে ফাঁকেও দেখতে হতে হয়। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যৌনচরন নিয়ে অশালীন অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা ও ছবি দিয়ে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়।

যার ফলে পর্নো আসক্ত ব্যাক্তির যৌন চাহিদা সাময়িক ভাবে বাড়িয়ে তোলে যা ভবিষ্যতকে অন্ধকার করার ইঙ্গিত।

পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে হস্তমৈথুন্য সহ নানারকম শারীরিক রোগের সম্মুখীন হতে হয়। ফলে, পর্নো আসক্ত ব্যাক্তি হয়ে ওঠে ক্রমশ বিকারগ্রস্ত যার প্রভাবে তিনি নানারকম অনৈতিক কাজে পা বাড়ায়।

মানুষ কেন পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়?

আমাদের শরীরে ডোপামিন নামক একটি হরমোন আছে। যখন একজন ব্যাক্তি পর্নোগ্রাফি দেখে তখন তাঁর মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হয়।

ডোপামিন আমাদের শরীরের এমন একটি হরমোন যা আমাদের কষ্ট, কান্না ভুলিয়ে হাসি-খুশি রাখে। তো যখন কেউ পর্নো দেখে তখন সে তার সকল ধরনের কষ্ট ভুলে যায়।

ডোপামিন হরমোনের প্রভাবে ভালো লাগার কারণে পর্নোগ্রাফিতে মেতে থাকে যা মস্তিষ্কে একটি অভ্যাস তৈরি করে যা পরবর্তীতে ওই ব্যাক্তিকে পুনরায় পর্নো দেখতে আগ্রহী করে তোলে।

সহজেই বলা যায়, ডোপামিন মস্তিষ্কে যৌন তৃপ্তি ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি সেটরন হরমোনও আমাদের ভালো লাগাতে সাহায্য করে যা নিউরনে এই অভ্যাসটি স্থায়ী করে। ঠিক এভাবেই আমাদের পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি সৃষ্টি হয়।

প্রথম দিকে অনেকে স্বাভাবিক বিষয় মেনে পর্নো দেখা শুরু করে। কিন্তু নিয়মিত দেখতে দেখতে উপরের এই প্রক্রিয়ায় এটি একটি ভয়াবহ অভ্যাসে পরিণত হয়।

উল্লেখ্য, ডোপামিন হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ আমাদের মস্তিষ্কসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে মারাত্মক ক্ষতি করে। যার ফলে সৃষ্টি হয় বিষন্নতা, অবসাদ, ক্লান্তি, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, যৌন-আকর্ষন কমে যাওয়া এবং দৈনন্দিন কর্মক্ষমতা ও যৌনক্ষমতা কমে যাওয়া।

একপর্যায়ে, পর্নো আসক্ত ব্যাক্তির পার্টনারের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয় যার ফলে সম্পর্কে মনোমালিন্য তৈরি হয়।

পর্নোগ্রাফি আসক্তির লক্ষণ

পর্নোগ্রাফি আসক্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে পারে, তাই এর লক্ষণ চেনা অনেক সময় কঠিন হয়। এর অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো নৈতিক দায়িত্ব বা সম্পর্কের ক্ষতির পরও পর্নোগ্রাফির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি। অনেকেই লক্ষ্য করেন, তারা অনলাইনে অশ্লীল কনটেন্ট খুঁজতে প্রচুর সময় ব্যয় করছেন এবং সেই উত্তেজনা ধরে রাখতে আরও নতুন বা চরমপন্থী কনটেন্ট খুঁজছেন।

এই আচরণ প্রায়শই অপরাধবোধ বা লজ্জার সৃষ্টি করে, কিন্তু এর প্রতি আকর্ষণ থামে না। পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে ভোগা মানুষদের মধ্যে সঙ্গীর প্রতি আবেগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বাস্তব জীবনের সম্পর্কের চেয়ে ভার্চুয়াল ফ্যান্টাসিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে থাকা, কাজের ক্ষেত্রে অমনোযোগী হওয়া এবং নিজের ব্যবহারের ধরন লুকানোর চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত।

এমনকি, এই সমস্যার কারণে অনেক সময় অস্থিরতা বা উদ্বেগও দেখা যায়, যখন কেউ অশ্লীল কনটেন্টে প্রবেশ করতে পারেন না। দীর্ঘমেয়াদে এটি সম্পর্কের স্বাভাবিক ধারণাকে বিকৃত করতে পারে এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এই লক্ষণগুলো চেনা এবং মেনে নেওয়া সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ। পরামর্শক বা সহায়তা গোষ্ঠীর সহায়তায় সঠিক পথে ফিরে আসা সম্ভব এবং জীবনের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা যায়।

পর্নোগ্রাফি আসক্তি এর কারণঃ

পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। যার কারণে খুব অল্প সময়েই যে কেউ এতে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। চলুন কিছু কারণ দেখা যাক-

  • ধর্মীয় শিক্ষা চর্চা না করার অভ্যাস।
  • ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাঃ ইন্টারনেটের এই যুগে পুরো বিশ্ব এখন একজনের নিজ হাতের মুঠোয়। তাতে একজন ইচ্ছে করলেই যেকোনো পর্নো সাইট থেকে পর্নো ভিডিও,অডিও, স্থির চিত্র নামাতে পারে।
  • একাকিত্বঃ পরিবারের লোকজন বিশেষ করে বাবা মা থেকে সন্তানেরা নির্দিষ্ট সময় না পাওয়ার কারণে তারা একাকিত্বে ভোগে। যেসময় তারা পর্নোগ্রাফিসহ নানারকম অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও, স্বামী -স্ত্রী নিজেরা নিজেদেরকে সময় না দেওয়ার কারণে হয়ে থাকে।
  • চারপাশের অসামাজিক পরিবেশের প্রভাব।
  • ব্যাক্তিত্বের ধরণ।
  • সুস্থ -স্বাভাবিক বিনোদনের অভাব।
  • মানসিক চাপ।
  • সমবয়সীদের প্রভাব।
  • অল্প বয়স থেকে অত্যাচার, মারধরের শিকার হওয়া।
  • অসৎ সঙ্গ দোষে।
  • পরিবারের সদস্যদের সাথে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর অভাব।
  • মাদকাসক্ত হওয়া।

এছাড়াও, আরো অসংখ্য কারণ হতে পারে আপনার বাচ্চা অথবা আপনার পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়ার পিছনে।

পর্নোগ্রাফি আসক্তি এর চিকিৎসাঃ

পর্নোগ্রাফি আসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। বর্তমান সময়ে প্রায় ৭০% তরুণ ছেলে মেয়েরাই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পুরো যুবসমাজ অধঃপতনে যাক, এটা মোটেও কাম্য না।

আমাদেরকেই বিভিন্ন সচেতনতার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তো চলুন কী কী কাজ করলে সহজেই পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকে বের হওয়া যাবে –

  • শুরুতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পর্নোগ্রাফিকে না বলুন।
  • ভালো ভালো বই পড়ুন।
  • নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
  • পর্নোগ্রাফির কথা সহজেই মাথায় না আনুন।
  • ধর্মীয় চর্চা করুন।
  • একা একা থাকা পরিহার করুন।
  • পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটান। এক্ষেত্রে, বাবা -মায়েরও উচিত সন্তানদের সময় দেওয়া
  • পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়ায় হীনমন্যতায় ভুগগবেন না।
  • অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করুন। এক্ষেত্রে, পরিবারের বাকি সদস্যদেরও নজরে রাখা উচিত কার সাথে আসক্তসম্পন্ন ব্যাক্তিটি মেলামেশা করছে।
  • একা একা ঘুমোবেন না, নির্জন নিরিবিলি এলাকায় থাকবেন না। তাতে মুহূর্তেই আপনার পর্নো দেখার ইচ্ছে জেগে উঠতে পারে।
  • ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন।
  • ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক হোন।
  • প্রয়োজনে সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হোন।
  • বিভিন্ন পর্নো ওয়েবসাইটকে ব্লক করুন।
  • আপনার ডিভাইসে পর্নো সংশ্লিষ্ট যেকোনো অডিও, ভিডিও, ছবি ডিলিট করুন।
  • নিজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।

এছাড়াও, আপনি চাইলে পর্নো আসক্তি দূরীকরণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করুন। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি আসক্তি নিরাময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞরা কাউন্সিলিং করছে।

তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক বেশি সুপরিচিত মানসিক হাসপাতাল “নিরাময় হাসপাতাল”, যেখানে নেশাগ্রস্থ এবং মানসিক রোগীদের জন্য চিকিৎসা দিয়ে আসছে। আপনি প্রয়োজনে এই হাসপাতালের কর্তব্যরত বিশেষজ্ঞদের সাথে কাউন্সিলিং করতে পারেন।

এখানে কর্তব্যরত রয়েছে অনেক প্রফেশনাল সাইক্রিয়েটিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইক্রিয়েটিস্ট, মেডিকেল অফিসার, কাউন্সিলার এবং নার্স যারা তাদের সম্পূর্ণ প্রচেষ্টায় একজন রোগীকে মানসিকভাবে ট্রিট করে থাকে। ইতোমধ্যে, অনেকেই এখানে কাউন্সিলিং বা চিকিৎসার মাধ্যমে নিজেদের মানসিক সমস্যা থেকে রিকোভার করতে পেরেছে।

এছাড়াও, এখানে ড্রাগ আসক্ত ব্যাক্তিদেরও সুচিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। তাই, আপনিও চাইলে পর্নোগ্রাফি আসক্তির চিকিৎসার জন্য এখানে যোগাযোগ করতে পারেন।

উপসংহার

পর্নোগ্রাফির আসক্তির কুফলে যেকোনো পার্নো আসক্ত ব্যাক্তি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমাজের সকল ধরনের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ পর্নোগ্রাফি আসক্তি। এই পর্নোগ্রাফি আসক্তির ফলে অনেকেরই তাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাচ্ছে। ফলে সমাজ ইভটিজিং, ধর্ষনসহ নানা রকম ব্যাভিচারে ভরে যাচ্ছে।

একজন পর্নো আসক্ত ব্যাক্তি নিজেকে সমাজ থেকে গুটিয়ে নেয়। কারণ তিনি অনেকধরণের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। ফলে তার স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া সহ নানারকম উৎপাদনশীল কাজের দক্ষতা হারিয়ে ফেলে।

পর্নোগ্রাফি আসক্ত ব্যাক্তির শারীরিক সমস্যা থেকে শুধু করে মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়। তাই আমাদের সমাজকে যেকোনো উপায়ে পর্নোগ্রাফির আসক্তি থেকে বের করতে হবে। এবং একটি সুন্দর, সুস্থ সমাজ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাইলে এটা সম্ভব করতে পারি। এজন্য আমাদেরকে অনেক পর্নোগ্রাফি আসক্তি ও চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

BOOK APPOINMENT