|

বয়ঃসন্ধিকালে-শারীরিক-ও-মানসিক-পরিবর্তন

বয়ঃসন্ধিকালঃ শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন

একটা শিশু জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনের অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে। এর মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বা সময় হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধিকাল এ একটা ছেলে কিংবা মেয়ের নানাবিধ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন: শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, আচরণগত পরিবর্তন ইত্যাদি।

আজকের আর্টিকেলে আমরা ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল কী সে সম্পর্কে জানবো। এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে কী কী পরিবর্তন হতে পারে এবং এতে পরিবারসহ সমাজের অন্যান্য পক্ষের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও আলোকপাত করবো।

বয়ঃসন্ধিকাল কী? কখন আসে এই পরিবর্তন?

শুরুতেই জানা প্রয়োজন, বয়ঃসন্ধিকাল কী? জীবনের যে পর্যায়ে একটা শিশু শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে সেই সময়টাকে আমরা বয়ঃসন্ধিকাল বা Puberty বলি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্যমতে, ১০-১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে বলা হয় কৈশোর এবং কৌশোরের যেকোনো সময়ই ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধি ঘটতে পারে। সাধারণত ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বয়ঃসন্ধি আগে হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১১-১৫ বছর বয়স আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা ১০-১৩ বছর বয়সে হয়ে থাকে।

এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের উপরে নির্ভর করে বয়ঃসন্ধিকালের এই সময়ে ভিন্নতা আসতে পারে। যেমন: দেশ, জলবায়ু, পরিবেশ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি ভেদে ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধি আগে কিংবা পরে হতে পারে।

বয়ঃসন্ধিকালে-শারীরিক-ও-মানসিক-পরিবর্তন

বয়ঃসন্ধিকালে কী কী পরিবর্তন হতে পারে?

বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাকে বলা হয় জৈবিক গঠনিক পর্যায়। এ সময় ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে এবং প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে ওঠে।

বয়ঃসন্ধি পাড় করা ছেলে কিংবা মেয়ের প্রতি পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতন আচরণ করা উচিত। এজন্য কোন সময়টা বয়ঃসন্ধির এবং বয়ঃসন্ধিকালে কী কী পরিবর্তন হতে পারে সে সম্পর্কে কিশোর-কিশোরী ছাড়াও অবিভাবকদেরও ধারণা রাখতে হবে।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের যেসব পরিবর্তনগুলো হতে পারে সেগুলো হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

শারীরিক পরিবর্তন

বয়ঃসন্ধিকালে একটা ছেলে কিংবা মেয়ের বেশ কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আর এ থেকে ধারণা করা যায় যে ছেলে কিংবা মেয়েটি বয়ঃসন্ধি চলছে।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের যেসব পরিবর্তন ঘটে:

  • দ্রুত দৈহিক উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধি পায়।
  • পেশি শক্ত ও সুগঠিত হতে থাকে।
  • কাধ ও বুক চওড়া হতে থাকে।
  • দাড়ি, গোফ গজানো সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম গজায়।
  • গলার স্বর কিছুটা ভারী হতে থাকে।
  • মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত হতে পারে।

বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যেসব পরিবর্তন ঘটে:

  • খুব দ্রুত উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
  • শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পরিপক্বতা লাভ করে।
  • শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম গজায়।
  • নিয়মিত মাসিক বা ঋতুস্রাব হয়ে থাকে।

মানসিক পরিবর্তন

এই সময়টাতে হর্মোনজনিত কারণে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেশ কিছু মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ছেলেদের মানসিক পরিবর্তন ঘটে Testosterone এর কারণে আর মেয়েদের ক্ষেত্রে OestrogenProgesterone হর্মোন।

এই মানসিক পরিবর্তনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে ভালো অথবা খারাপ পথে পরিচালিত করে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনগুলো প্রায় একই হয়।

এ সময় যেসব পরিবর্তন ঘটে:

  • অন্যের উপরে নির্ভরশীলতা পরিহার করে আত্মনির্ভরশীল হয়।
  • আবেগ দ্বারা চালিত হয়।
  • বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।
  • নিজের প্রতি অন্যের আগ্রহ লাভের ইচ্ছা পোষণ করে।
  • মুড সুয়িং হয়, অর্থাৎ মানসিক অবস্থা খুব দ্রুত উঠানামা করে।
  • মানসিক পরিপক্কতা লাভ করতে শুরু করে।

আচরণগত পরিবর্তন

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেশ কিছু আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এসব পরিবর্তন দেখে অন্যকেউ ধারণা করতে পারে কোনো শিশুর বয়ঃসন্ধি শুরু হয়েছে কিনা।

এ সময়ে যেসব আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়:

  • প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করে।
  • নিজস্ব মতামত ও সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
  • বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজে প্রবৃত্ত হয়।
  • নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
  • নিজ কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা পছন্দ করে।
  • নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে।

সামাজিক পরিবর্তন

সমাজের সাথে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েদের খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

বয়ঃসন্ধিকালে যেসব সামাজিক পরিবর্তন ঘটে:

  • একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
  • পরিবারের সদস্যদের চেয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে।
  • বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে।

সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালে পরিবারের ভূমিকা

ইউনিসেফ (UNICEF) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের বেশি ছেলে-মেয়ে বয়ঃসন্ধিকাল পাড় করে। কিন্তু আমাদের দেশে বয়ঃসন্ধির বিষয়টি খুবই অবহেলার সাথে দেখা হয়, যা আসলেই কাম্য নয়। এই অবহেলার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যেহেতু এটি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তরকালীন সময়, তাই এই সময়টাতে ছেলে-মেয়ে, পরিবারের অন্য সদস্যসহ সমাজের সকল পক্ষের উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন দায়িত্ব পালন করা।

একটা শিশুর বয়ঃসন্ধিতে পরিবার ও সমাজের অন্য পক্ষসমূহ যেসব ভূমিকা পালন করতে পারে সেগুলো হলো-

● সচেতনতা বৃদ্ধি:

অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকরা এই সময়ে ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারেন এবং কীভাবে নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হয় সে বিষয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেন।

অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করলে ভাই-বোন কিংবা ঘনিষ্ঠ কেউ তাদের সাথে কথা বলতে পারেন।

● সন্তানের মতামতকে সম্মান করা:

এই সময়ে ছেলে-মেয়েরা হরমোন জনিত পরিবর্তনের কারণে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকে। এতে অনেক সমমে অভিভাবকরা রেগে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেন।

এমনটি না করে অভিভাবকদের কৌশলী হয়ে তাদেরকে বোঝাতে হবে। তাদের মতামতের অসম্মান হয় এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়।

● স্বাস্থ্যসেবায় সচেতন হওয়া:

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের খুব দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে দেহে প্রচুর পুষ্টি ও সুষম খাবারের চাহিদা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

● পুষ্টিকর খাদ্যতালিকা তৈরি:

এ সময়ে সন্তানের নিয়মিত খাদ্যতালিকার ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন দায়িত্ব পালন করা জরুরি। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় যেন প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, কার্বোহাইড্রেট, জিংক সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফলমুল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

● সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা:

এই সময়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেকগুলো মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তারা হঠাৎ করেই খিটখিটে মেজাজের হয়ে যেতে পারে। তাদের মানসিক পরিবর্তন বুঝতে তাদেরকে সময় দিতে হবে।

এছাড়া বন্ধুদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ভুল পথে যাচ্ছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নেতিবাচক কিছু দেখলে হঠাৎ কিছু করে না বসে বুঝিয়ে বলতে হবে, সঠিক ও ভুলের পার্থক্য অনুধাবন করতে শেখাতে হবে।

সারসংক্ষেপ

ছেলে-মেয়েদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এ বিষয়ে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মাঝেই অনীহা ও অসতর্কতা লক্ষ্য করা যায়।

সমাজের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই শিশু, কিশোররা। তাই তাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া উচিত নয়।

এজন্য ছেলে-মেয়ে ও অভিভাবক উভয়েরই বয়ঃসন্ধিকাল কী, এ সময়ে কী কী পরিবর্তন ঘটে এবং এতে পরিবারের ভূমিকা কী সে ব্যাপারে জানতে হবে। আশা করছি, আজকের আর্টিকেলে সেসব তথ্য জানাতে পেরেছি।

এ বিষয়ে আরও কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে তা কমেন্টে করে জানাতে পারেন। এছাড়া শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ও চিকিৎসা প্রদানে নিরাময় হাসপাতাল আছে সবসময় আপনার পাশে।

BOOK APPOINMENT